You are currently viewing জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের জীবনী ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার
সৈয়দ নজরুল ইসলাম

জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের জীবনী ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নেতা, যুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ১৯২৫ সালে। অনন্য এ বীর জন্ম নেন তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলায়, বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার যশোদল ইউনিয়নের বীরদামপাড়া গ্রামে।

তাঁর দাদা সৈয়দ আব্দুর রইস জন্মের পর তাঁর নাম রাখেন গোলাপ। পরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নাম রাখা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মা- বাবা আর ভাই-বোনদের সাথে তাঁর শৈশব কাটে ময়মনসিংহ জেলাতেই।

সৈয়দ নজরুল ইসলামের পড়ালেখা শুরু হয় যশোদল মিডল ইংলিশ স্কুল থেকে। তার কিছুদিন পরে ভর্তি হন কিশোরগঞ্জ আজিমুদ্দিন হাই স্কুলে। মোট দুবার স্কুল বদল করে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ২ বিষয়ে লেটার পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৪১ সালে। ম্যাট্রিকে অনবদ্য এ ফলাফলের পরে ভর্তি হন আনন্দমোহন কলেজে। ১৯৪৩ সালে ১ম বিভাগে আই এ পাশ করেন। উচ্চশিক্ষার প্রতি আকাঙ্ক্ষা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়তে আসেন। ১৯৪৬ সালে ইতিহাস বিষয়ে বি.এ.(অনার্স) পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে সম্পন্ন করেন এম. এ। এই ১৯৪৬-৪৭ সালেই তাঁর রাজনীতি শুরু। নিষ্ঠাবান এ নেতা ১৯৪৬-৪৭ সালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের সহ সভাপতি হিসাবে জয়লাভ করেন। ছিলেন ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদকও।

সিলেট ভাগে জনমত গঠন

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় দুই দেশের সীমানা ঠিক হয়েছে। তবে সিলেট ভারতে হবে নাকি পাকিস্তানে, তা নিয়ে চলছে বেশ বিতর্ক। এ সমস্যা সমাধানে আয়োজন করা হয় গণভোটের। সিলেট যাতে পাকিস্তানে হয় তাই প্রচারণা চালাতে সিলেট যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম। একই সময়ে সিলেটে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠনে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সিলেটেই পরিচয় হয় এই দুই ছাত্র নেতার। গড়ে উঠে সুসম্পর্ক। এ সম্পর্ক স্থায়ী ছিল আজীবন।

ভাষা আন্দোলনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম

সৈয়দ নজরুল ইসলাম মায়ের ভাষার প্রতি অপমান মেনে নিতে পারেননি। বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি রাজপথে সোচ্চার হন। এ সময় তিনি সর্বদলীয় একশন কমিটির সদস্য ছিলেন। একইসাথে সিলেট রেফারেন্ডামের ছাত্র প্রতিনিধি দলের আহ্বায়ক হিসাবেও দ্বায়িত্ব পালন করেন। আর যাই হোক, ভাষা আন্দোলনে তিনি যে বেশ বড় ভূমিকা রেখেছিলেন তা অনস্বীকার্য।

সৈয়দ নজরুল ইসলামের কর্মজীবন

বাবার ইচ্ছা ছিল তিনি যেন সি. এস. পি. অফিসার হন। বাবার স্বপ্ন পূরনে ১৯৪৯ সালে সি. এস. পি. পরীক্ষা দিয়ে উর্ত্তীণ হন । চাকুরি পান কর বিভাগে অফিসার হিসাবে। তবে বেশিদিন চাকুরি করেননি তিনি। উর্ধতন এক কর্মকর্তার সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় মাত্র ১ বছর পরই ১৯৫১ সালে চাকুরি ছেড়ে দেন।

১৯৫১ সালে চাকুরি ছেড়ে দেওয়ার পর  শিক্ষকতা শুরু করেন। নিজেকে নিযুক্ত করেন আনন্দমোহন কলেজে ইতিহাস অধ্যাপনায়। এর মাঝে ১৯৫৩ সালে উর্ত্তীণ হন এলএলবি পরীক্ষায়। ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহ বার কাউন্সিলে যোগ দেন। শুরু করেন আইন পেশা।

নজরুল ইসলামের পারিবারিক জীবন

১৯৫০ সালে বিয়ে করেন কটিয়াদীর বনেদি পরিবারের মেয়ে বেগম নাফিসা ইসলামকে। তাদের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় ৪ পুত্র, ২ কন্যা। পুত্রদের মধ্যে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম রাজনীতিতে যোগ দেন। বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী ছিলেন তিনি। আর কন্যাদের মধ্যে সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি সংসদ সদস্য হিসাবে কর্মরত আছেন।

মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী রাজনীতি

উদার এ নেতা বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৫৭ সালে। এসময় তিনি পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদকে কাউন্সিলের মাধ্যমে হারান। এই পদের দ্বায়িত্বে ছিলেন ১৯৭২ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ সভাপতির দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে শুরু হয় ৬ দফার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন। আন্দোলন চলাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।  দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন ১৯৬৬ সালের ৯ মে। নিষ্ঠার সাথে দ্বায়িত্ব পালন করেন ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত।

শেখ মুজিবুর রহমানকে রক্ষাতেও তাঁর অবদান আছে। আগরতলা মামলা নামে প্রহসনমূলক মামলা করে শেখ মুজিবকে ফাসি দেওয়ার চেষ্ঠা করে পাকিস্থানি শাসকরা। এসময় সৈয়দ নজরুল ইসলাম শেখ মুজিবের অন্যতম আইনজীবী হিসাবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে আবার শুরু হয় আন্দোলন। এই গণঅভ্যূর্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মিলে গঠন করে ডেমোক্রেটিক একশন কমিটি নামে সর্বদলীয় এক একশন কমিটি। এ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতাও ছিলেন তিনি। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতায় অচলাবস্থা শুরু হলে ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আর ১০-১৩ মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে সরকার, বিরোধী দলগুলোর সাথে বৈঠক করে। এ বৈঠকে আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা হিসাবে যোগ দেন।

১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তিনি ময়মনসিংহ -১৭ আসন থেকে এম. এন. এ নির্বাচিত হন। নির্বাচিতদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় আবার শুরু হয় আন্দোলন। ১৯ মার্চ ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের সাথে যে বৈঠক করেন, সেখানেও প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজনীতি

২৫ মার্চ কাল রাতে শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। তিনি গ্রহন করেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দ্বায়িত্ব। ২৫ মার্চ রাতে তিনি অবস্থান করেছিলেন চক্ষু চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরীর বাসায়। ২৬ মার্চ সকালে ডাক্তাররের স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর  সহায়তায় বিধবা নারীর ছদ্দবেশ ধারন করেন। রিক্সায় করে চলে যান নরসিংদীতে। পথে পাকিস্থানী আর্মি দুবার রিক্সা থামালেও রিক্সাচালকের সহায়তায় রক্ষা পান। নরসিংদী থেকে চলে যান কটিয়াদী। সেখানে তাঁর অবস্থান প্রকাশ হয়ে পরলে কিশোরগঞ্জে আসাদুজ্জামানের বাসায় স্থান নেন। পুত্র সৈয়দ আশরাফ আর হামিদুল হকের সহায়তায় জিপে করে মধ্যরাতে পৌছান হালুয়াঘাট সীমান্তে। ভোর হওয়ার আগেই পার হয়ে যান ভারত সীমান্ত।

কিছুদিনের মধ্যে তাঁর পরিবারের বাকিরা ভারতে পৌছান। সপরিবারে থাকতেন পার্ক সার্কাসের সি. আই. টি কলোনির বাড়িতে। মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান আর সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক দ্বায়িত্ব দিয়ে সরকার গঠন করা হয়। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আর সশস্ত্র বাহিনীর অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক হিসাবে ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বদ্যিনাথতলার আম্রকাননে শপথ নেন।

তাঁর নেতৃত্বেই এক এক ধাপ করে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় স্বাধীনতার দিকে। অক্টোবর মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের সাথে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমেদ, ইন্দিরা গান্ধী রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এ বৈঠকে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাশিয়ার সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালান। এই আলোচনার ফলেই ভারত সরকার ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। যশোর সেনানিবাসের পতন হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। সেনানিবাসের পতন হলে তিনি যশোর আসেন। তাঁর কিছুদিনের মধ্যেই শেষ হয় মুক্তিযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতি

মুক্তিযুদ্ধ শেষে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে শিল্প মন্ত্রনালয়ের দ্বায়িত্ব নেন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে ময়মনসিংহ ২৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায়। পালন করেন জাতীয় সংসদের উপনেতার দ্বায়িত্বও। ১৯৭৫ সালে তিনি উপরাষ্ট্রপতি হন। একই সাথে নতুন গঠিত কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশালের সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। শিল্প মন্ত্রী থাকাকালীন নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন, শিল্পবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি আর শিল্প কারখানা জাতীয়করণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন।

মৃত্যূ

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরে তাকে গৃহবন্দি করা হয়। খন্দকার মুশতাক আহমেদের নির্দেশনায় জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান এবং এম. মনসুর আলীর সাথে তাকে গ্রেফতার করা হয় ১৯৭৫ সালের ২৩ আগষ্ট। গ্রেফতার করে রাখা হয় ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে। ৩ নভেম্বর নেতাদের নিয়ে যাওয়া হয় কারাগারের বিশেষ একটি কক্ষে। খন্দকার মুশতাকের অনুসারীরা ৪ সৈন্যের সহায়তায় গুলিবিদ্ধ করে আর বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করে তাদের। তাকে কবর দেওয়া হয় বনানী কবরস্থানে।