You are currently viewing এ এইচ এম কামারুজ্জামানের জীবনী ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান
এ এইচ এম কামারুজ্জামান

এ এইচ এম কামারুজ্জামানের জীবনী ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান

বাংলাদেশের ইতিহাসে মহান এক নেতার নাম হচ্ছে এ এইচ এম কামারুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধে এই নেতার অনবদ্য অবদান ছিল। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গঠিত অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত একজন মন্ত্রী ছিলেন। সৎ নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক নেতা হিসাবে তার অনেক পরিচিতি ছিল।

তিনি নাটোর জেলার অন্তর্গত বাগান্ধী পাড়ার মালঞ্চ রেলস্টেশন সংলগ্ন নুরপুর গ্রামে তার মামার বাড়িতে ১৯২৩ সালের ২৬ শে জুন জন্মগ্রহণ করে থাকেন। এএইচএম কামরুজ্জামান এর পিতার বাড়ি হচ্ছে রাজশাহী জেলার কাদিরগঞ্জ গ্রামে এবং তার বাবা ছিলেন সেই সময়কার একজন বনেদী জমিদার। এ এইচ এম কামারুজ্জামানের পিতার নাম আব্দুল হামিদ এবং তার মাতার নাম ছিল বেগম জেবুন্নিসা। তাদের ১২ ভাইবোনের মধ্যে কামরুজ্জামান ছিলেন সবার বড়।তার ডাকনাম ছিল হেনা।

সবাই তাকে সংক্ষেপে হেনা বলে ডাকতো। এ এইচ এম কামারুজ্জামান ১৯৫১ সালে জাহানারা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রীর পৈতৃক নিবাস হচ্ছে বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার চামরুল গ্রামে। এ এইচ এম কামরুজ্জামান ছিলেন ছয় সন্তানের পিতা।তিনি ছিলেন চার মেয়ে এবং দুই সন্তানের পিতা। তার বড় ছেলে এ এইচএম খায়রুজ্জামান বর্তমানে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র।

এ এইচএম কামরুজ্জামানের শিক্ষা জীবন

তিনি লেখাপড়া শুরু করেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে। তিনি যে সময় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করতেন সেই সময় তার ফুফা ছিলেন সেই স্কুলের একজন শিক্ষক। তার ফুপা যখন পরবর্তীতে রাজশাহী থেকে চট্টগ্রাম এর বদলী হয়ে চলে যান তখন কামরুজ্জামানকে তার সাথে নিয়ে যান এবং চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে তিনি তাঁকে ভর্তি করে দেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকেই ১৯৪২ সালে মাধ্যমিক পাস করেন।

তারপর তিনি পরবর্তীতে রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন এবং পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে তিনি কলকাতায় যান এবং বিখ্যাত কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে অর্থনীতিতে অনার্স পাস করেন। তারপর তিনি আবার দেশে ফিরে আসেন এবং রাজশাহী আইন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৫৬ সালে তিনি জর্জ কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

এ এইচ এম কামারুজ্জামানের রাজনৈতিক জীবন

তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন সৎ ও নির্ভীক নেতা। তার নানা সেই সময় কংগ্রেস রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। কামরুজ্জামানের পিতা মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন এবং দীর্ঘদিন রাজশাহী অঞ্চলের মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্বটা তিনি নিজে থেকে পালন করেন। তাছাড়া এ এইচ এম কামারুজ্জামান এর বাবা ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলাদেশ ও পূর্ব বঙ্গের আইন পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। তাই এ এইচ এম কামরুজ্জামান তার বাবার সান্নিধ্যেই রাজনীতিতে আসেন।

এ এইচএম কামরুজ্জামান ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে অনেকটা সংক্রিয় ছিলেন। আর এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের রাজশাহী জেলা শাখার সম্পাদক হন। তারপরে তিনি ১৯৪৩-১৯৪৫ পর্যন্ত ছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগের নির্বাচিত একজন সহ-সভাপতি। কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগে যোগদান করেন ১৯৫৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে। তারপর তিনি আস্তে আস্তে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের হয়ে নিজেকে মেলে ধরেন। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ১৯৫৭ সালে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।

তারপরে ১৯৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনে কার্যকারী ভূমিকা পালন করেন। তারপরে তিনি ১৯৬৭ সালের দিকে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে নির্বাচিত হন। তার কিছুদিন পরেই আয়ুব খান সরকারের নির্যাতনের বিপক্ষে তিনি ওই সময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির জন্য পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ছিল তার কার্যকারী ভূমিকা। তারপরে ১৯৭০ সালের দিকে সারা পূর্বপাকিস্তানে অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐসময়ে ৫ জন সদস্যবিশিষ্ট দলীয় হাইকমান্ড গঠন করেন। আর সাধারনত এই হাইকমান্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়ে থাকে এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে।

এ এইচ এম কামরুজ্জামানের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভূমিকা

এ এইচ এম কামরুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যে সরকার গঠন করা হয়েছিল সেই সরকারের অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন এ এইচ এম কামরুজ্জামান। নবগঠিত মুজিবনগর সরকার তাকে সরাষ্ট্র কৃষি ও ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয় সেই সময়ে। তিনি সেই সময়ে মুক্তিযুদ্ধাধের বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন এবং তাদেরকে ত্রাণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান না থাকাকালীন সময়ে তারা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি খুব ভালোভাবে পরিচালনা করেছেন যা বঙ্গবন্ধুর না থাকাকে কোন সময় বুঝতে দেয়নি। এ এইচএম কামরুজ্জামান তাজউদ্দিন আহমেদের সাথে নিরলসভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশে কাজ করে গিয়েছেন।

এ এইচ এম কামারুজ্জামানের যুদ্ধ পরবর্তী কালীন ভূমিকা

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করার পর তিনি ও অন্যান্য নেতাকর্মী ও মন্ত্রীদের সাথে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তারপরে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ১০ ই জানুয়ারি দেশে ফিরে আসলে পুনরায় সরকার গঠন করা হয়। আর শেখ মুজিবুর রহমান যে সরকার গঠন করেন সেখানে তিনি ত্রাণ ও পূর্ণবাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। তারপরে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রীর পদ নিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তারপরে তিনি ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে রাজশাহীতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তারপরে এ এইচ এম কামরুজ্জামান ১৯৭৪ সালে মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন।আর সেই সময়ে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। ১৯৭৫ সালে যখন নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় তখন এ এইচ এম কামরুজ্জামান মন্ত্রিসভায় শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এবং মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি নিরলসভাবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য লড়াই করে গিয়েছেন।

এ এইচ এম কামারুজ্জামানের মৃত্যু

বাংলাদেশের একজন মহান নেতা ছিলেন এ এইচ এম কামারুজ্জামান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হাজার ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট খুন হওয়ার পর এএইচএম কামরুজ্জামান সহ আরো জাতীয় তিন নেতাকে কারাবন্দি করা হয়। তাদের জেলে নিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর ১৯৭৫ সালের ৩ই নভেম্বর কিছু সেনা সদস্য ও জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আর যেখানে এএইচএম কামরুজ্জামান এর মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডকে আখ্যায়িত করা হয়েছে জেলহত্যা দিবস নামে।

পরিশেষে

পরিশেষে,যুগে যুগে যত নেতা এসেছে বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম করে গিয়েছে তাদের মধ্যে এ এইচ কামরুজ্জামান অন্যতম। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও নির্ভীক নেতা। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করে গিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকে তার আগের সময় পর্যন্ত তার ছিল কার্যকারী ভূমিকা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য।

বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারা দেশের হাল ধরে পাকিস্তানের সাথে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে বাংলাদেশকে জয়লাভ এনে দিয়েছেন। তাই এ এইচ এম কামারুজ্জামান বাংলাদেশের মানুষের বুকে সারা জীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কেননা তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহান নেতা।