You are currently viewing মোহাম্মদ মনসুর আলীর জীবনী। Biography of Captain Monsur Ali
মোহাম্মদ মনসুর আলী

মোহাম্মদ মনসুর আলীর জীবনী। Biography of Captain Monsur Ali

মোহাম্মদ মনসুর আলীর জীবনী-(Biography of Captain Monsur Ali)ঃ যাদের অবদান ও ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ব্যক্তিত্ব হলেন মোঃ মনসুর আলী। তিনি একজন জাতীয় নেতা, রাজনীতিবীদ, আইনজীবী এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ভালোবাসার মানুষ ও বিশ্বস্ত সহচর, যা্রা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরাধীন বাংলাকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন।

এক নজরে মোঃ মনসুর আলী

মুল নামঃ মুহাম্মদ মনসুর আলী

ডাকনামঃ ক্যাপ্টেন মনসুর

জন্মঃ ১৬ জানুয়ারী ১৯১৯ সালে

জন্মস্থানঃ সিরাজগঞ্জ জেলার রতনকান্দি ইউনিয়নে

পেশাঃ আইনজীবী, রাজনৈতিক, সেনাসদস্য

উপাধিঃ ক্যাপ্টেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী

ধর্মঃ ইসলাম

চুখের কালারঃ কাল

চুলের কালারঃ কাল

শরীরের কালারঃ শ্যামলা

জাতীয়তাঃ বাংলাদেশী

ভাষাঃ বাংলা

বৈবাহিক অবস্থাঃ বিবাহিত

সন্তানঃ ২ ছেলে

এক ছেলের নামঃ মোহাম্মদ নাসিম

দ্বিতীয় ছেলের নামঃ মোহাম্মদ সেলিম

বাবার নামঃ হরফ আলী সরকার

মৃত্যুঃ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর

মোহাম্মদ মনসুর আলীর প্রাথমিক জীবন

মহান এই নেতা ১৯১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জ জেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের কুড়িপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মনসুর আলীর বাবা ‘হরফ আলী সরকার’ এবং মা ‘বেগম রওশনারা’। দশ ভাই-বোনদের (পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোন) মধ্যে মনসুর আলী ছিলেন নবমতম। তিনি বিয়ে করেন রংপুরের তৎকালীন স্বনামধন্য জেলা জজ আমীরউদ্দিন সরকারের কন্যা বেগম আমিনা কে। সহধর্মিনী মাইনা বেগমের বাড়ি ছিলো গাইবান্ধার পলাশবাড়ী থানায়।

মোহাম্মদ মনসুর আলী ও বেগম আমিনা ছয় সন্তানের (পাঁচ পুত্র ও এক কন্যা) জনক- জননী। মো মনসুর আলীর বড় পুত্র ডঃ মোহাম্মদ সেলিম একজন আইজীবী এবং তিনি একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যানের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং সেই সাথে সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুরে তার পিতার নির্বাচনী এলাকা প্রতিনিধিত্বকারী একজন এমপি ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

তার দিত্বীয় সুযোগ্য পুত্র মোহাম্মদ নাসিম ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের টেলিকম ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনিও বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন প্রভাবশালী নেতা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এমনকি মোহাম্মদ নাসিমের পুত্র ইঞ্জিনিয়ার তানভীর শাকিল জয়ও সাবেক এমপি ছিলেন এবং পিতা ও পিতামহের পদাঙ্ক অনুসরন করে দেশ ও দেশের জনগনের সেবা করে যাচ্ছেন।

আরো পড়ুনঃ জাতীয় চার নেতার জীবনী

মোহাম্মদ মনসুর আলীর শিক্ষা জীবন

শিক্ষাজীবনে মোহাম্মদ মনসুর আলী ছিলেন খুবই মেধাবী, যিনি শিক্ষাজীবনে পাঁচ বার বৃত্তি পেয়েছিলেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল কাজিপুরের গান্দাইল মাইনর স্কুলের মাধ্যমে। পরবর্তিতে তিনি চলে যান সিরাজগঞ্জ বিএল উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং সেখান থেকেই তিনি ১৯৩৫ সালে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর তিনি ‘পাবনা’ এডয়ার্ড কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই আইএ (উচ্চ মাধ্যমিক) পাস করেন।

মোঃ মনসুর আলী ‘কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪১ সালে বিএ পাস করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত সুপ্রতিষ্ঠিত আলীগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সেখান থেকেই ১৯৪৫ সালে এমএ (অর্থনীতি) এবং এলএলবি তে ডিগ্রি অর্জন করেন।

মোহাম্মদ মনসুর আলী ১৯৪৮ সালে যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণ নেন এবং তখন থেকেই তিনি “ক্যাপ্টেন মনসুর” নামে পরিচিতি পান। তবে তিনি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন না, ছিলেন পিএলজির (পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড) ক্যাপ্টেন।

এরপর ১৯৫১ সালে পাবনা জেলা আদলতে তিনি আইন চর্চা শুরু করেন এবং ১৯৫৮ সালে তিনি যোগ দেন পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্ট বারে। মোহাম্মদ মনসুর আলী আইনজীবী হিসেবে একজন সফল আইনজীবী ছিলেন এবং পাবনা আইনজীবী সমিতির তিনবার সাধারণ সম্পাদক ও পাঁচবার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ সালে মনসুর আলী ‘পাবনা আইন কলেজ” প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৭০ সালের ১ জুলাই থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত কলেজের অবৈতনিক অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তারই উদ্দ্যোগে ১৯৭২ সালে কলেজের নামকরন করন করা হয় “ শহীদ আমিনউদ্দিন আইন” কলেজ।

কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ-এ পড়াশোনা চলাকালীন সময়েই মোহাম্মদ মনসুর আলী রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেন এবং তখনই শেখ মুজিবুরের সাথে তার পরিচয় হয়। এরপর দেশে ফিরে তিনি দেশীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পরেছিলেন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব আমজাদ হোসেন, জনাব আমিন উদ্দিন অ্যাডভোকেট, আবদুর রব বগা মিঞা প্রমুখের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।

আরো পড়ুনঃ সৈয়দ নজরুল ইসলামের জীবনী

মোহাম্মদ মনসুর আলীর রাজনীতি

তিনি ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত পাবনা জেলা মুসলিম লীগের সহ সভাপতি ছিলেন। ১৯৫১ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য হন ও দলের পাবনা জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে উর্দুকে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন এবং গ্রেফতার হন। মোঃ মনসুর আলী এবং তার দল দাবি করেছিল যে ‘বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক এবং প্রদেশগুলিকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হোক।’

তার মুক্তির পর, ক্যাপ্টেন মোঃ মনসুর আলী ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মনোনিত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। উক্ত নির্বাচনে পাবনা-১ আসনের মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদকে পরাজত করে তিনি বিপুল ভোটে জয় লাভ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।

১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় ক্যাপ্টেন মোঃ মনসুর আলী বিভিন্ন মেয়াদে পূর্ববঙ্গ কোয়ালিশন সরকারে আইন, সংসদ বিষয়ক, খাদ্য ও কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের নেতৃত্বে মোঃ মনসুর আলীকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং সামরিক আইন জারি করেন। তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত বন্দী থাকেন এবং ১৯৫৯ সালের শেষদিকে কারামুক্ত হন।

আরো পড়ুনঃ এ এইচ এম কামরুজ্জামানের জীবনী

ছয় দফা আন্দোলনে মোঃ মনসুর আলী

১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে যখন শেখ মুজিবুর রহমান আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করেছিলেন এবং সামরিক শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন, তখন তার নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলী উক্ত আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন করেন এবং পাবনা-১ আসন থকে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের লগ্নে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হলে মোঃ মনসুর আলী গ্রেফতার এড়াতে সেনাবাগ কলোনীতে চলে যান। সেখান থেকে কেরানীগঞ্জ হয়ে কুড়িপাড়া গিয়ে তার পরিবারের সাথে দেখা করেন। এরপর ভারতে চলে যান এবং সেখানে আশ্রয় নেয়া অন্যন্য নেতাদের সাথে দেখা ও যোগাযোগ করেন। একই বছরের মাঝামাঝি সময়ে মনসুর আলীর পরিবারও কলকাতা পৌঁছে এবং তারা সপরিবারে পার্কসার্কাসের সিআইটি রোড়ের বাড়িতে বসবাস করতে থাকেন।

এরপর দলীয় হাই কামান্ডের নেতারা মিলে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে মুজিবনগর সরকার গঠন করেন এবং মুজিবনগর সরকারে অর্থমন্ত্রী হন ক্যাপ্টেন মোঃ মনসুর আলী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মোঃ মনসুর আলী প্রথমে যোগাযোগ ও পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। হার্ডিঞ্জ ব্রীজ মেরামতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ করেন।

আরো পড়ুনঃ তাজউদ্দীন আহমদের জীবনী

জাতীয় সংসদ সদস্য ক্যাপটেন মনসুর আলী

৭মার্চ ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে পুনরায় ক্যাপটেন মনসুর আলী পাবনা-১ আসনে থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং একই বছর আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি দলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে একদলীয় রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী সভার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মুজিবুর রহমান কতৃক ১৯৭৫ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি গঠিত বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) সাধারণ সম্পাদক হন।

মৃত্যু

১৫ আগস্ট ১৯৭৫, শেখ মুজিবকে পরিবারসহ হত্যা করা হলে খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা দখল করেন এবং মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান এবং তাজউদ্দীন আহমদের মতো আওয়ামী লীগ নেতাদের ২৩ আগস্ট সেনাবাহিনী কর্তৃক তাদের গ্রেফতার করান।এরপর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলী সহ ৪নেতাদের হত্যা করা হয়।

মোহাম্মদ মনসুর আলীর স্মরণে

দেশ গঠনের মহান এই নেতার আবদানের স্বীকৃতিসরুপ তার নামে একমাত্র বিশেষায়িত শহীদ (ক্যাপ্টেন) এম মনসুর আলী জাতীয় হ্যান্ডবল স্টেডিয়াম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় প্রশাসনিক ভবনের নামকরণ, সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের নামকরণ, ঢাকায় বেসরকারি শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ, পাবনায় শহীদ এম মনসুর আলী কলেজ এবং সিরাজগঞ্জের একটি রেল স্টেশনের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ এম মনসুর আলী রেলওয়ে স্টেশন।