You are currently viewing তাজউদ্দীন আহমদের জীবনী ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান
তাজউদ্দীন আহমদ

তাজউদ্দীন আহমদের জীবনী ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান

তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ছিলেন একজন অন্যতম নেতা। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্বাধীনতার পর তাজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী।তাজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অগ্রনায়ক।

তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ শে জুলাই গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিলেন মৌলবী মোহাম্মদ ইয়াসিন খান এবং মাতার নাম ছিলেন মেহেরুন্নেসা খান।

তাজউদ্দিন আহমেদের স্ত্রীর নাম হচ্ছে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। তিনি ছিলেন সেই সময়কার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর একজন সদস্য। তাদের পরিবারের চারটি সন্তান রয়েছে। তাদের পরিবারের সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান হচ্ছে তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ

তাজউদ্দীন আহমদের শিক্ষাজীবন

তাজউদ্দিন আহমদের পড়াশোনা শুরু বাবার কাছে শৈশবে আরবি শেখার মাধ্যমে। তখন তিনি ভর্তি হন বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ভুলেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

সেই সময়ে তিনি প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর তিনি যখন চতুর্থ স্থানে ওঠেন তখন ভর্তি হন তার বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ স্কুলে।

তাজউদ্দিন আহমদ পড়েছেন কালিগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশন ও মুসলিম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। তাছাড়া তিনি ঢাকা এবং সেন্ট গ্রেগরিজ উচ্চ বিদ্যালয়ে ও পড়েছেন।

তাছাড়া আরেকটি বিষয় হল তাজউদ্দিন আহমেদ কোরআনে হাফেজ ছিলেন যা তিনি বাপের সান্নিধ্যে অর্জন করেন। তিনি মেট্রিক ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবিভক্ত বাংলায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় যথাক্রমে দ্বিতীয় ও চতুর্থ স্থান লাভ করেন।

তারপর যথাক্রমে হাজার ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ ডিগ্রী লাভ করেন।হাজার ১৯৬৪ সালের রাজনৈতিক ঝামেলার কারণে তিনি থানায় বন্দি থাকা অবস্থায় এল.এল.বি পরীক্ষা দেন এবং ভালভাবে পরীক্ষায় উর্তীণ হয়।

আরো পড়ুনঃ মোহাম্মদ মনসুর আলীর জীবনী

তাজউদ্দিন আহমেদ এর রাজনৈতিক জীবন

আবুল কাশেম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর হাজার ১৯৪৩ সালের পর তাজউদ্দীন আহমদ মুসলিম লীগের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে পড়েন।

তারপর তিনি হাজার ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। তারপর তিন হাজার ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের অন্যতম উদ্যোক্তাও ছিলেন তিনি। তাছাড়া তিনি ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য। তারপরে ১৯৫৪ এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হিসেবে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক কে পরাজিত করে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।

তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৬৪ সালে প্রাদেশিক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়। পরর্বতিতে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বসম্মতিত্রমে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন ১৯৬৬ সালে।

১৯৬৬ সালের ৬ ই ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান যখন ৬ দফার দাবিতে সম্মেলন করেন তখন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারপরে এই বছরের ৮ ই মে তিনি দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালে তিনি যখন জেলে থাকেন তখনই তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত হন। তারপরে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এর মাধ্যমে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান।

তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭০ সালে আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তৃতীয় বার নির্বাচিত হন। তারপরে এই বছরের সাধারণ নির্বাচনের জন্য গঠিত আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সেক্রেটারি হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। আর তারপরে ১৯৭০ সালের ৭ ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

আরো পড়ুনঃ সৈয়দ নজরুল ইসলামের জীবনী

তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিযুদ্ধকালীন জীবন

শেখ মুজিবুর রহমান যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন তখন হাজার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে। তারপরে সেই সময়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার পরপরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।

প্রথম পর্যায়ে আত্মরক্ষা এবং তারপর যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং সর্বশেষে পাল্টা আক্রমণ এই নীতি কে সামনে রেখে তিনি সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেন। তাই সেই সময়ে তাজউদ্দিন আহমেদ আত্মগোপন করেন এবং যুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য সীমান্তের পাশে রওনা হন। তারপর তিনি ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম কে সঙ্গে নিয়ে ৩১ শে মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পদার্পণ করেন।

সীমান্ত অতিক্রম করার পর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কেএম রুস্তমজী তাদের আশ্রয় স্থালে তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি আরো অনেক বিষয়ে জানতে চান।

সীমান্তে পৌঁছে তাজউদ্দীন আহমদ দেখেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারত সরকার থেকে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সামরিক বাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছুই করার নেই।

তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিযুদ্ধকালীন আরো কিছু কথা

তারপরে মুক্তিফৌজ গঠনের জন্য তাজউদ্দিন আহমেদ বিএসএফের সহযোগিতা চাইলে মুক্তি সেনা ট্রেনিং এবং অস্ত্র প্রদান এসব কাজ অনেক সময় সাপেক্ষ।

তিনি আরো বলেন ভারত সরকার ট্রেনিংয়ের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না জানালে তারা ট্রেনিংয়ের জন্য অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন না। তারপরে এই কথা কে এম রুস্তমজী দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করলে তখন তাকে বলা হয় তাজউদ্দিন আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমির আলীকে নিয়ে সরাসরি দিল্লি চলে আসতে।

উদ্দেশ্য ছিল মূলত তাজউদ্দিন আহমদ ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠক। তারপরে তাজউদ্দিন আহমেদ দিল্লির যাওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন গোপন সূত্র থেকে খবর পান যে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তার যুদ্ধের আহমেদের যখন বৈঠক শুরু হয় তাজউদ্দিন আহমেদ শুরুতেই বলেন যে ২৬ মার্চে বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে।

শেখ মুজিবুর রহমান সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট। ইন্দ্রারাগান্ধির সাথে তিনি যে বৈঠক করেন সেই বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। ভারতের ততকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রাগান্ধির তাকে এই বলে ভরসা দেন যে তাদেরকে উপযুক্ত সময়ে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দিন আহমদ এর আনুষ্ঠানিক আলোচনা

তারপরে চারটা এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দিন আহমদ এর আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়। তারপরের দশই এপ্রিল মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়। তারপরে ১১ এপ্রিল তাজউদ্দিন বেতারে ভাষণ দেন। তারপরে ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

তখন তাজউদ্দীন আহমদ হন সেই সময়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। আর শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সেই সময়ের সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আর এই অস্থায়ী সরকার ১৬ ই ডিসেম্বর এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সব কার্যক্রম কলকাতা থেকে পরিচালনা করে।

১৭ ই এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের পর তাজউদ্দিন আহমেদ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম কে সাথে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। তারপরে ওই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাকে গার্ড অফ অনার দিয়ে ভারতে নিয়ে যায়।

তাজউদ্দিন আহমদের মৃত্যু

হাজার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় তখন সেই হত্যাকারীদের নির্দেশেই তাজউদ্দীন আহমদ কে গৃহবন্দি করা হয়। তারপরে ২৩ শে আগস্ট সামরিক আইনের অধীনে তাজউদ্দিন আহমদ সহ ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপরে তাদেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। তারপরে ৩ রা নভেম্বর কারাগারের ভেতরে তাজউদ্দিন আহমেদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় যা সাধারণত আমাদের ইতিহাসে জেলহত্যা দিবস হিসেবে পরিচিত।

পরিশেষে

পরিশেষে, তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অগ্রনায়ক। তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীদের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর এর যত টুকু গুরুত্ব রয়েছে তাজউদ্দিন আহমেদের ঠিক ততটা গুরুত্ব রয়েছে।