You are currently viewing বাউল সম্রাট লালন শাহর জীবনী । লালন গীতি। লালনের উক্তি
লালন

বাউল সম্রাট লালন শাহর জীবনী । লালন গীতি। লালনের উক্তি

লালন জিনি একজন বাংলার কবি,সুরকার,এবং বাউল সাধক। লালন এর জন্ম ১৭ অক্টোবর ১৭৭2 খ্রিস্টাব্দের তৎকালীন অভিবক্ত বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) এর ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ড উপজেলার হারিশপুর গ্রামে। তবে কিছু কিছু লালন গবেষক মনে করেন, তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানার চাপড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত ভাড়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই মতের সাথেও অনেকে সহমত নয় আর তাই বাংলা ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসের প্রকাশিত একটি, মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার এক প্রবন্ধে তার জন্ম উল্যেখ করা হয়েছে যশোর জেলার ফুলবাড়ী গ্রামে। এই মতবিরোধের কারণ হচ্ছে তিনি নিজে কখনো তার জন্ম কোথায় তা প্রকাশ করেন নাই।

লালন শাহর প্রাথমিক জীবন

লালন ছিলেন বিভিন্ন ধরণের প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালি। তাকে কে আমরা ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন সহ আরো বিভিন্ন নাম চিনে থাকি। তিনি ছিলেন একজন বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সেবক, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। তিনি তার জীবনে অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার, গায়ক ছিলেন। আর তাই তাকে বাউল গানের অগ্রদূতদের একজন হিসেবে দেখা হয়। এর পাশাপাশি আমরা তাকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবেও নাম দিয়ে থাকি। এই বাউল সম্রাটের গানের মাধমের উনিশ শতকে বাউল গানের এত্ত জনপ্রিয়তা অর্জন পায়।

শাহ ছিলেন এমন একজন সাধক যিনি সব সময় মানবতার জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি কখনো কোনো জাতিগত ভেদাভেদ করেননি। আর মানবতাকে সবচাইতে উপরে স্থান দিয়েছিলেন। আমাদের সমাজের এই অসম্প্রদায়িক এই মনোভাব যাতে না থাকে তার জন্যই তিনি সবসময় তার গান রচনা করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সহ আরো বিভিন্ন খ্যাতনামা কবি. সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী ছাড়াও আরো বিভিন্ন জন তার গান ও দর্শনের জন্য যুগে যুগে প্রভাবিত হয়েছে। তার গানগুলো প্রধানত বাউল গান হলেও বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও সব যুগেই তার গান বিভিন্ন সংগীত শিল্পীর কণ্ঠেই উচারিত হয়েছে। ভারত উপমহাদেশে তাকে সার্বপ্রতিম ‘মহাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

লালন জীবনী

লালনের জীবন সম্পর্কে তেমন কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি অতি সাধারণ ভাবে জীবনযাপন করতেন। শাহর সম্পর্কে গুরুত্ব পূর্ণ একটি তথ্য হচ্ছে তার লিখা ২৮৮ টি গান রয়েছে। তবে তার লিখা কোনো গানে তার নিজের জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা দেননি। কিন্তু কিছু গান আছে, যেখানে তিনি নিজেকে ‘লালন ফকির’ নাম উপস্থাপন করেছেন। তিনি মারা যাবার ঠিক পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হিতকরী নামের এক পত্রিকাতে বলা হয়, “ইহার জীবনী লিখিবার কোনো উপকরণ পাওয়া কঠিন।

নিজে কিছু বলিতেন না। শিষ্যরা তাঁহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞতাবশত কিছুই বলিতে পারে না। কোনো এক বিশেষ সূত্রে জানা যায় শাহের পিতার নাম ছিলেন কাজী দরীবুল্লাহ দেওয়ান। তার পিতামহের নাম ছিলেন কাজী গোলাম কাদির এবং মাতার নাম ছিলেন আমিনা খাতুন। সাইর্জী কাজী বংশের ছিলেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গবেষকরা তাদের গবেষণার সূত্রে জানান তার আরো ডুই ভাই ছিলেন। তাদের নাম ছিলেন আলম শাহ এবং কলম শাহ। কেও কেও আবার বলেন তারা চার ভাই ছিলেন। শাহ তার শৈশবেই বাবাকে হারান। শুধু মাত্র তার মায়ের আদরেই তিনি বেড়ে উঠেন। বাবা বেঁচে না থাকায় আর পরিবারের বড় ছেলে হবার কারণে অনেক ছোটবেলা থেকেই তাকে সংসারের বোঝা কাঁধে নিতে হয়।

পৃথিবীতে মা ছাড়া তার আর কেও ছিল না। বিয়ে করলে যদি মায়ের সেবার কোনো কমতি না হয় সে কথা ভেবে লালন বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন অকেজো নীতিবান ব্যাক্তি। তার সাথে পরিবারের অন্য সাদসদের মিল না হওয়ায় তিনি তার মা আর স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বসবাস করতেন। এই সংসার চালানোর কারণে তার আর লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তিনি খুব ছোট বেলা থেকেই গান বাজনার সাথে জড়িত ছিলেন। মনে পরনে এই গানকে ভালোবাসতেন।

লালন সাঁইজির প্রথম মৃত্যু

কোনো একদিন লালন তার জীবনে পুণ্য অর্জনের উদ্যেশে যৌবনের শুরুতে তার ভাড়ারা গ্রামের দাসপাড়া প্রতিবেশিদ বাউলদাশ সহ অন্যান আরো সঙ্গী-সাথীদের সাথে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরপুরে গঙ্গা তে স্নানের উদ্দেশে যান। ওই সময় রাস্তা ঘাটের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ ছিল। মাটির রাস্তা তার মধ্যে ছিল বর্ষার কাদা আর গ্রীষ্মের ধুলো। এর মধ্যে পায়ে হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় ও ছিল না। কারণ ওই সময় বাহন ছিল হাতে গুনা কয়েক টা, তাও আবার ঘোড়া কিংবা গরুর গাড়ি। যা কেবল মাত্র সমাজের হাতে গুনা কয়েকটি উঁচু পরিবারের লোকজনই চড়তো। তাও সংখ্যায় খুবই কম ছিল।

তিনি গঙ্গা স্নান শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় পথের মধ্যে হঠাৎ করে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। রোগের যন্ত্রনা প্রবল পরিমানে বেড়ে যাওয়াতে এক সময় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তা দেখে সবাই মনে করেন তিনি মারা গেছেন। আর তাই তার সঙ্গী-সাথীরা তার মুখাগ্নি করে তাকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেন। তার পর সঙ্গীরা তার বাড়িতে এসে তার মা আর স্ত্রীকে তার করুন মৃত্যুর খবর জানান। তার এমন মৃত্যুর খবর শুনে তার মা আর স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়েন।

লালনের নবজীবন

 অন্যদিকে এই বাউল সম্রাটের দেহ নদীর জলে ভাসতে ভাসতে পারে গিয়ে পৌঁছায়। একজন মহিলা নদীতে কলসি কাখে পানি আন্তে গিয়ে দেখে একজন মানুষ পানিতে ভাসছে যে যেকোন ও জীবন্ত। সে দেখলো তার চোখের পাতা, হাত-পা নড়ছে। আর এই দৃশ দেখে মহিলাটি তাকে নদী থেকে তুলে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। কিন্তু মহিলাটি ছিল মুসলিম পরিনারের গৃহবধু। সেই বাড়িতে তিনি অনেক সেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার এই বসন্ত রোহে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায় আর তার মুখে অনেক গভীর খত হয়। শাহ সুস্থ হয়ে নতুন জীবন ফিরে পায়। এ যেন তার আরো একবার জন্ম হলো। তিনি সুস্থ হয়ে মনের আনন্দে তার প্রিয় মা আর বাড়িতে ফিরে যান।

লালনের মা তাকে কে জীবিত দেখে আনন্দে উল্লসিত হয়ে পড়েন। তার স্ত্রী ও সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানায়। কিন্তু সব আনন্দ এক নিমিষেই শেষ হয়ে যায়। গ্রামের লোকজন যখন শুনে যে তিনি জীবিত আছে তখন তারা দোলে দোলে শাহকে দেখতে আসে। সেই সাথে আসে সমাজের কিছু সমাজপতি। তারা বলে যার অন্তুষ্টিক্রিয়া হয়ে গেছে তার উপর সে এত দিন থেকে এসেছে একটি মুসলিম পরিবারে আর সে বাড়ির জল ও পান করেছে তাই তাকে আমাদের এই সমাজে থাকতে দেওয়া হবে না। আর তাই তিনি তার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। এই দুঃখ সহ্য না করতে পেরে কিছুদিন পর লালনের স্ত্রী মারা যান।

লালনের নতুন জীবনের চিন্তা

যে সমাজের কথা চিন্তা করে লালন ধর্মের জন্য গঙ্গা স্নানে গিয়ে মরতে বসেছিল, আর সেই সমাজ শাহকে তার সব কিছু থেকে বের করে দিলো এই কারণে তিনি অনেক কষ্ট পায়। আর এই ঘটনার পর থেকেই সাইর্জীর সকল ভাবনার বিকাশ ঘটে। এর পর শাহর মরমী সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সাথে দেখা হয়। সিরাজ সাঁই ছিলেন একজন সাধক পুরুষ। ওনার কাছে আসার পর থেকেই শাহের আধ্যাত্বিক চিন্তার প্রকাশ পায়, আর তিনি হয়ে ওঠেন একজন আধ্যাত্বিক চিন্তা চেতনার পুরুষ। সিরাজ সাঁইকের সার্নিধ্যে থেকে তিনি হয়ে উঠেন ফকির লালন সাঁই।

তিনি চিলের গুরু ভক্ত একজন। তার সব গানে এই জিনিসটা বুজা যায়। তিনি হাজার বেস্ত থাকলেও এক মুহূর্তের জন্যও তার মাকে ভুলে থাকতে পারে নি। মায়ের আদর ভালোবাসার কথা বার বার তাকে কষ্ট দিতো। তার মনের গভীরে বুকের ভেতর তার মা ছিল। আর এটা বুজা যায় সে যখন তার মায়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে তখন মায়ের শেষ কাজের সবকিছু পাঠিয়ে দেন। জাতের কারণে তিনি সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্যুত করেন। আর তার কারণেই জাত-পাতের বিরুদ্ধে লালনের গানের ভাষায় যুদ্ধ করতেন।

সব শেষে জানা যায় শাহ পরে আর কোনো ধর্মেরই ছিল না। তিনি সকল ধর্মের মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর বাংলা ১২৯৭ সালের ১ কার্তিক শুক্রবার সকাল ৫টায় ১১৬ বছর বয়সে এই বাংলার মানুষের বাউল সম্রাট মরমী সাধক শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর আগে ভোর ৫টায় তিনি তার ভক্তদের উদ্যেশে বলেন ‘আমি চলিলাম’ .এই আধাঘন্টা পরেই তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। লালন এমন একজন বাউল ছিলেন যিনি এই সমাজের সবার জন্য মন থেকে কাজ করে গেছেন। তার অবদান অনেক।