You are currently viewing ড. আসিফ নজরুলের জীবনী ও ক্যারিয়ার
আসিফ নজরুল

ড. আসিফ নজরুলের জীবনী ও ক্যারিয়ার

ড. আসিফ নজরুল-(Biography of Dr. Asif Najrul); জন্মগতভাবে মোঃ নজরুল ইসলাম,যিনি ড. আসিফ নজরুল নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। তিনি অত্যন্ত মেধাবী, নীতিবান ও সাহসী একজন ব্যক্তি। তিনি বর্তমান তরুন প্রজন্মের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন লেখক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। দশটিরও বেশি উপন্যাস ও নন-ফিকশন বইএর রচয়িতা আসিফ নজরুল।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক। পাশাপাশি তিনি একাধারে একজন রাজনীতি বিশ্লেষক,সংবিধান বিশেষজ্ঞ, একজন কলামিস্ট, লেখক ও ঔপন্যাসিক। তিনি বিশেষভাবে খ্যাত ও আলোচিত তার টেলিভিশন টকশো এবং তার কলামে সাহসী রাজনীতি বিশ্লেষণের জন্য। তিনি মুক্ত চিন্তা ও আইনের শাসনের প্রবক্তা।

আসিফ নজরুল ১৯৬৬ সালের ১২ জানুয়ারি ঢাকার লালবাগে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তার বাবা ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তারা ছয় ভাইবোন ছিলেন এবং তিনি বাবা- মায়ের মেঝো ছেলে ছিলেন। তার বড় ভাই মতিউর রহমান সিদ্দিকী ছিলেন খুবই মেধাবী একজন সাংবাদিক।

আসিফ ছোট বেলা থেকেই বই পড়তে পছন্দ করতেন। তিনি পাবলিক লাইব্রেরীতে অনেক সময় কাটাতেন এবং তার বড়ো ভাইএর সাথে প্রচুর বই পড়তেন ছাত্র জীবনে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুনিল গঙ্গোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ প্রভৃতি লেখকদের বই অনেক পড়তেন।

ড. আসিফ নজরুলের শিক্ষা জীবন

তিনি ১৯৮০ সালে ওয়েস্টার্ন স্কুল থেকে মাত্র পনরো বছর বয়সে মেট্রিকে (এসএসসি) ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করেন এবং বোর্ডে মানবিক বিভাগে ১০ম স্থান অধিকার করেছিলেন। এইচএসসি পাস করার পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। তিনি ১৯ ৮৬ সালে স্নাতক (LLB) এবং ১৯৮৭ সালে স্নাতকোত্তর (LLM) শেষ করেন।

এরপর তিনি চলে যান সোয়াস (School of Oriental and African Studies) ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন (University of London) এবং সেখান থেকে তিনি PhD সম্পন্ন করেন। সোয়াসে একজন কমনওয়েলথ ফেলো হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি এনভাইরনমেন্টাল ল’ (Environmental Law Centre) সেন্টার থেকে পোস্ট ডক্টরেট ফেলোশীপ (Post Doctorate Fellowship) অর্জন করেন।

আরো পড়ুনঃ মুহাম্মদ জাফর ইকবালের জীবনী

ড. আসিফ নজরুলের কর্মজীবন

১৯৯১ সালে আসিফ নজরুলের কর্মজীবন শুরু হয় বিচিত্রা পত্রিকায় সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে। এই পত্রিকায় লেখালেখি করার সময়ই তার নাম মোঃ নজরুল ইসলাম থেকে আসিফ নজরুল করা হয়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বিসিএস এর প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এরপর তিনি বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে ২য় স্থান অধিকার করে সরকারি ম্যাজিস্ট্রেট হন। কিন্তু মাত্র ৩৬ দিন তিনি সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন।

আসিফ নজরুলকে বিভিন্ন সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দেখা যায়, যেমন- আল-জাজিরা, বিবিসি (BBC), সিএনএন (CNN) ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন- UNDP, ADB মানবাধিকার সংস্থা,আইনের শাসন, পরিবেশগত সমস্যা ইত্যাদি সংস্থার সাথে একজন কনসালটেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন।

বির্তকিত বক্তব্য

১৯১২ সালের ১২ মার্চ একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে দেয়া বক্তব্যের কারনে তাকে হাই কোর্টে ডাকা হয়। তিনি উক্ত টিভি চ্যানেলে অগণতান্ত্রিক শক্তিকে উসকানি দিয়েছেন বলে একটি রিট আবেদন করলে আদালত এই আদেশ দেন। একই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী মতাহের হোসেন ভবনের আইন অনুষদের ১০৮/এ  নজরুলের কক্ষে তালা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় কিছু শিক্ষার্থীরা।

এমনকি ‘রাজাকারদের দালাল’, ‘আসিফ নজরুল রাজাকার, এ মুহূর্তে বাংলা ছাড়’, ‘নজরুলকে ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা হলো’, এসব লিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সামনে টানিয়ে দেয়া হয়।
স্লোগান ৭১-এর সভাপতি শিবলীর মতে তার অপরাধ ছিল- তিনি এক টেলিভিশনের টকশোতে বলেছিলেন-”আমি যুদ্ধপরাধীদের বিচার চাই; কিন্তু সাইদী যুদ্ধপরাধী নয়।”

২০১৩ সালের মে মাসে আসিফ নজরুলকে একটি টেলিটক নাম্বার থেকে হত্যার হুমকি দিয়ে বলা হয় তিনি যেনো আর কোনো টকশোতে অংশগ্রহণ না করেন। এরপর তিনি শাহবাগ থানায় এ নিয়ে একটি জিডি ফাইল করেন। আসিফ সরকারের সমালোচনা করেন বলে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয় হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়।

নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানের ভাইয়ের মামলা

১৯১৭ সালের ২৩ নভেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খানের চাচাতো ভাই জেলা পরিষদের সদস্য ফারুখ খান মাদারীপুর আদালতে আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে ৫০০ ও ৫০১ নম্বর ধারায় মানহানির মামলা দায়ের করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো- তিনি তার ফেইসবুকে চট্টগ্রাম বন্দরে লস্কর নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন।

২০২১ সালের ১৭ আগস্ট আসিফ নজরুল তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজে তিনি লিখেন,”সুষ্ঠু নির্বাচন হলে কাবুল বিমান বন্দর ধরণের দৃশ্য বাংলাদেশেও হতে পারে।”
তার কথার প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ নেতারা এবং মুক্ত মঞ্চের নেতা কর্মীরা আক্রমণাত্ম্যকভাবে তার কক্ষে তালা দেয় এবং দরজা ও দেয়ালে রাষ্ট্র দ্রোহিতার নামে পোষ্টার লাগায়।

এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান, মানবাধিকার সুলতানা কামাল, জাফরউল্লাহ চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ, লেখক রেহনুমা আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের আধ্যাপকগণ সহ দেশের বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গ বিবৃতি প্রদান করেন।

নিয়মিত সাহিত্য চর্চা

আসিফ নজরুল রাজনৈতিক ও পেশাগত জীবনের মধ্য দিয়েও সাহিত্য চর্চা করতে পিছপা হন নি। তার লেখা প্রথম উপন্যাস নিষিদ্ধ কয়েকজন; বইটিতে তিনি তার সেই সময়কার দুর্দান্ত তারুন্যের কিছু চমকপ্রদ কাহিনী লিখেছেন। তিনিই প্রথম ফুল কভার স্টোরি করেন অবৈধ অস্ত্রের উৎস এবং তার এই অবৈধ অস্ত্রের উৎস নিয়েই একজন মডেল ছবি তুলার কারণে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাতে হয়েছিলো। তিনি জনপ্রিয় লেখিকা জাহানারা ইমামকে নিয়েও বিচিত্রাতে কভার স্টোরি করেছিলেন।

তার প্রথম বই নিষিদ্ধ কয়েকজন বইটির লেখক পরিচিতি লিখেছিলেন জাহানারা ইমাম, বইএর কাভার করেছিলেন সেই সমকার জনপ্রিয় নায়ক আফজাল হোসেন, ইলাস্ট্রেশন করেছেন রফিকুন নবী রণবী। বইটি ছিল সেই সময়ের খুবই আলোচিত একটি বই।

তার আত্মজীবনীমূলক (Biography) উপন্যাস পিএইচডির গল্প খুবই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে তরুণ পাঠোকদের কাছে। বইটিতে তিনি শুধু তার পিএইচডি করার গল্পই লিখেননি, তার জন্মস্থান পুরাণ ঢাকার অলিতে- গলিতে বড় হয়ে উঠা থেকে শুরু করে পিএইচডি করা পর্যন্ত জীবনের নানা টানাপোড়ানের গল্প তিনি তুলে ধরেছেন। বইটি শুধু যে পিএইচডি হোল্ডারদের উদ্দেশ্যেই লেখা এমন না, সর্বপরি ছাত্র স্মাজের জন্য বইটি অনুপ্রেরনার উৎস ।

আসিফ নজরুলের প্রতিবেদন ও গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলো হলো- ‘১/১১ সুশাসন বিতর্ক’, ‘যুদ্ধাপরাধীর বিচারঃ জাহানারা ইমাম এর চিঠি’ এবং ‘আওয়ামী লীগের শাসনকাল’।

তার লেখা অন্যান্য উপন্যাসগুলো হলো-

– ক্যাম্পাসের যুবক, আক্রোশ, পাপ, উধাও, অন্য আলোর দিন, দখল, অন্যপক্ষ, তাদের একটি রাত, ছোঁয়া, অসমাপ্তির গল্প, বেকার দিনের প্রেম, ঘোর, মানবাধিকার, আওয়ামী আমল,সংসার

আরো পড়ুনঃ মুহাম্মদ ইউনূসের জীবনী

আসিফ নজরুলের পারিবারিক জীবন

আসিফ নজরুলের প্রথম স্ত্রী ছিলেন অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী। তিনি রোকেয়া প্রাচীকে বিয়ে করেছিলেন ২০০৪ সালে এবং ২০১৩ সালে তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। তাদের দুজনের একটি কন্যা সন্তান আছে। এরপর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আসিফ নজরুল বিয়ে করেন প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের মেয়ে শীলা আহমেদকে। তিনিও একজন অভিনেত্রী। তার অভিনিত বহুব্রীহি, কোথাও কেও নেই (১৯৯০), হিমু ১৯৯৪), প্রিয় পদরেখা (১৯৯২), ওইজা বোর্ড (১৯৯৫)। ১৯৯৪ সালে আগুনের পরশমণি সিনেমায় অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ জাতীয় শিশু শিল্পী পুরষ্কার পান।শীলা আহমেদেরও এটা ২য় বিয়ে। প্রথম সংসারে তার দুটি সন্তান আছে এবং আসিফ নজরুলের সংসারেও তার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।

অবশেষে

আসিফ নজরুল একজন অত্যন্ত স্পষ্টভাষী, নির্ভীক ও তোখড় বক্তা। তিনি অত্যন্ত মেধাবী একজন ব্যাক্তি, তিনি পড়তে ও জ্ঞান অর্জন করতে ভালোবাসেন। তিনি তার রিসার্চফুল বক্তব্যের কারণে দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে জনপ্রিয়। যত প্রতিকূল পরিস্থিতিই থাকুক না কেনো তিনি সত্যকে সত্য বলতে ভয় পান না। গুণী এই লেখকের জন্য রইলো শুভকামনা।

আরো পড়ুনঃ হুমায়ূন আহমেদের জীবনী