You are currently viewing রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনী ও সাহিত্য
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীবনী ও সাহিত্য

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে অনেকে বেগম রোকেয়া হিসেবে চিনে থাকেন।বেগম রোকেয়া হচ্ছে বাঙালির মুসলিম নারী জাগরণের একজন অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী। বেগম রোকেয়াকে সমাজ সংস্কারকও বলা হয়ে থাকে।বেগম রোকেয়ার সকল সময়ই নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে গিয়েছেন।

বেগম রোকিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে।তার পিতার নাম হচ্ছে জহুর উদদীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার এবং তার মা তার নাম হচ্ছে রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। বেগম রোকেয়ার ছিল দুই বোন এবং তিন ভাই। বেগম রোকেয়ার বড় বোনের নাম হচ্ছে করিমুন্নেসা এবং তার আরেক বোনের নাম হুমায়রা।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের পিতা আবু আলী হায়দার সাবের আরবি, উর্দু, ফার্সি, বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়ের শিক্ষার দিক থেকে তিনি বরাবরই ছিলেন রক্ষণশীল। কবি বেগম রোকেয়ার সাখওয়াত হোসেনের বড় ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহিম আবুল আসাদ ও খলিলুর রহমান আবু। রোকেয়ার দুই ভাই ই ছিল বিদ্যানুরাগী।

তারা সেইসময়ের কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যায়ন করে অনেকটা আধুনিকমনস্ক হয়ে ওঠেন। রোকেয়ার বড় বোন করিমুন্নেসা ছিলেন একজন সাহিত্য অনুরাগী। বেগম রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা ও সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনের পেছনে তার দুই ভাই এবং দুই বোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বেগম রোকিয়া যে সময়ে পড়াশোনা করেছিলেন সেই সময়ে মেয়েদের পড়াশোনা করার রীতি ছিল না। বেবু বেগম রোকিয়া যখন পাঁচ বছর বয়সে মার সাথে কলকাতায় বসবাস করছিলেন তখন কিছুদিন একজন মেম শিক্ষার্থীর কাছে তার শিক্ষাদানের সুযোগ হয়েছিল।

কিন্তু সমাজের কিছু লোক এবং আত্মীয় স্বজনের বাধানিষেধের কারণে তাকে সেটিও বন্ধ করে দিতে হয়। বেগম রোকেয়া কিন্তু তাও হাল ছেড়ে দেননি।বড় ভাই ও বোনদের সহযোগিতায় তিনি আরবি, উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি আয়ত্ব করেন খুব দ্রুতই।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বৈবাহিক জীবন

নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া হাজার ১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে তার বিয়ে হয়। তার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বেগম রোকেয়াকে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করেছেন তার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। তার স্বামী হাজার ১৯০৯ সালের ৩ ই মে মৃত্যুবরণ করেন। আর এর আগে বেগম রোকেয়ার দুটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করার পরেই মৃত্যুবরণ করেন।

বেগম রোকেয়ার সাহিত্য চর্চার সূচনা

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে হাজার ১৯০২ সালে।তার প্রথম রচনা পিপাসা ছাপা হয় সেই সময়ে কলকাতার বিখ্যাত নবপ্রভা পত্রিকায়। তারপর আস্তে আস্তে তার বিভিন্ন রচনা অনেক পত্রিকায় ছাপা হতে লাগলো।

রোকেয়ার প্রথম ইংরেজি রচনা সুলতানাজ কড্রিম ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয়। ইংরেজি রচনাটি একটি পত্রিকা ছাপা হয় যেটি মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত হত। তারপরে হাজার ১৯৫০ সালে তার প্রথম ইংরেজি রচনা সুলতানাজ কড্রিম” মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ছাপা হয়ে থাকে।

আস্তে আস্তে তার রচনা অনেকের পছন্দ হতে থাকে এবং সে একজন সাহিত্যিক হিসেবে অনেকের কাছে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন। বেগম রোকেয়া তার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন এর অনুপ্রেরণায় সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে তৈরি করেন। তাছাড়া তার সাহায্যে তিনি ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হন।

বেগম রোকেয়ার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন মারা যান ১৯০৯ সালে ফলে তাদের বিবাহিত জীবন অল্প সময় ছিল। তার ভাগ্য ছিল খুবই খারাপ। তার স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন মারা যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তার দুটি কন্যা সন্তানও মারা যায়।

বেগম রোকেয়ার ১৯০২ সালে পিপাশা নামের একটি গল্প লেখার মাধ্যমে সাহিত্য জগতে তাঁর অবদান রাখা শুরু হয়। তারপর তিনি একে একে লিখে ফেলবেন মতিচুরের প্রবন্ধগুলো এবং সুলতানা স্বপ্ন এর মত নারীবাদী বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। বেগম রোকিয়া এভাবেই বিভিন্ন রচনা ও সাহিত্য লেখার মাধ্যমে নিজেকে একজন সাহিত্যিক হিসেবে সবার কাছে পরিচিত করে তোলেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন বাঙালি একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড

নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য বেগম রোকিয়া সারাজীবনে সংগ্রাম করে গেছেন। তার স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি নারীশিক্ষা বিস্তার এবং সমাজ সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন হাজার ১৯০৯ সালে মাত্র ৫ জন ছাত্রীকে নিয়ে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন।

তখন তিনি ফেমেলির  কিছু কারণে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ভাগলপুর থেকে কলকাতা শহরে এসে বসবাস শুরু করেন। তারপরে তিনি কলকাতায় গিয়ে মাত্র ১৩ জন ছাত্রীকে নিয়ে আবারো সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন।তারপরে চার বছরের মধ্যেই রকেয়ার শিক্ষার্থীর সংখ্যা একশত পেরিয়ে যায়।

তারপর ১৯১৬ সালে বেগম রোকিয়া আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে নামে নারীদের একটি সংগঠন তৈরি করেন। তারপরে বেগম রোকিয়া ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নারী শিক্ষা বিষয়ক এক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। বেগম রোকেয়া যতদিন বেঁচেছিলেন নারীদের জন্য তিনি সংগ্রাম করে গিয়েছেন।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের যত অর্জন

বেগম রোকেয়া সারা জীবনই নারীদের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি ছিলেন সকল সময় সংগ্রাম করেছেন। বাংলাদেশের রংপুর বিভাগে ২০০৮ সালের ৮ ই অক্টোবর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।তারপরে ২০০৯ সালে নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে তার নাম কে স্মরণীয় রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি রাখেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। নারীর নামে তৈরিকৃত বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় এটি। তাছাড়া নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে আরো অনেক ভাবে সম্মানিত করা হয়েছে। যেমনঃ

১.বেগম রোকিয়া নামে বাংলাদেশের সর্বোচ্ছ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়া হল নামে ছাত্রীদের জন্য একটি হল প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্রীনিবাসটি প্রতিষ্ঠিত সাল ছিল ১৯৬০।

২.মহীয়সী বাঙালী নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদান কে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্য খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য আবাসিক হল বেগম রোকেয়া নামকরণ করা হয়েছিল।

৩.বাংলাদেশে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর তার জন্ম দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বেগম রোকেয়া দিবস পালন করা হয়।তাছাড়া নারী উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য বিশিষ্ট নারীদেরকে বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়।

৪. ব্রিটিশ প্রভাবশালী গ্ণমাধ্যম বিবিসি বাংলার ২০ জন সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির খুজে জরিপ করেন ২০০৪ সালে। বিবিসির সেই জরিপে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে তারা ৬ নাম্বার পজিশনে রাখেন। সেই জরিপে প্রথম নামটি ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের

বেগম রোকেয়ার নারীদের অধিকার আদায়ে অবদান

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন সমাজ সচেতন, কুসংস্কারমুক্ত, এবং প্রগতিশীল একজন মানুষ। বেগম রোকেয়া যে সময়ের জন্মগ্রহণ করেন সেই সময়ের নারীদের শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিলনা। শুধু তাই নয় সেই সময় নারীদের কোন কাজে অংশগ্রহণ করার তেমন সুযোগও ছিলনা। বেগম রোকেয়া এই বিষয়টিকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি নিজেও ওই সময়ে শিক্ষার প্রতি অনেক বেশি আগ্রহী ছিলেন।

বেগম রোকিয়া নিজের শিক্ষিত হয়েছেন তার কঠোর প্রচেষ্টায় এবং নারীদের শিক্ষিত করার জন্য তিনি কাজ করে গিয়েছেন। তার প্রথম প্রমাণ হচ্ছে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য বেগম রোকেয়া সারা জীবনের সংগ্রাম করে গিয়েছেন। সেই সময়ে বঞ্চিত নারী সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি যতটুকু পেরেছেন চেষ্টা করে গিয়েছেন। আর এই জন্যই রোকিয়া সাখাওয়াত হোসেনকে নারী সমাজের অগ্রদূত বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যু

নারী সমাজের সংস্কারক বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময়ে তিনি নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য একটি প্রবন্ধ লিখে গিয়েছিলেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের কবর উত্তর কলকাতার সোদপুরে অবস্থিত।

পরিশেষে, সাখাওয়াত হোসেন যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে গিয়েছেন। সমাজ থেকে তিনি নারীদের প্রতি সকল ধরনের কুসংস্কার দূর করতে চেয়েছেন। নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি সকল সময়ই ছিলেন সোচ্চার। তাই বেগম রোকেয়াকে নারী সমাজের অগ্রদূত বলা হয়ে থাকে।