You are currently viewing শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জীবনী এবং সাহিত্যকর্ম
জাহানারা ইমাম

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জীবনী এবং সাহিত্যকর্ম

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম-এক সংগ্রামী চেতনার নাম, মাতৃভূমির প্রতি যার আবদান ছিলো অনস্বীকার্য। যার নাম শুনলেই বাঙ্গালির হৃদয় হয় উদ্বেলিত। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হওয়া তরুন ‘শাফী ইমাম রুমী’র জননী আজ বাংলার ‘শহীদ জননী’র গৌরব অর্জন করেছেন। জাহানারা ইমাম একাধারে ছিলেন একজন কথাসাহিত্যিক, লেখিকা , শিক্ষাবীদ, নেত্রী, আলোচক ও উপস্থাপক।

জাহানারা ইমামের ডাক নাম ‘জুড়ু’, তিনি ৩ মে ১৯২৯ সালে একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তার জন্মস্থান বড়ঞা থানার সুন্দরপুর গ্রামে,এটি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে অবস্থিত। তার বাবা, সৈয়দ আব্দুল আলী ছিলেন একজন ডেপুটি মেজিস্ট্রেট এবং মা সৈয়দা হামিদা বেগম ছিলেন গৃহিনী। বাবার চাকরির সুবাদে জাহানারা ইমাম মুর্শিবাদের বিভিন্ন জায়গায় তার শৈশব কাটিয়েছেন। আর তিনি তার শৈশবের স্মৃতিকথা ফুটিয়ে তুলেছেন তার আত্মজীবনি গ্রন্থ- ‘অন্যজীবন’এ।

তৎকালীন সময়ে মুসলিম মেয়েদের পড়াশোনার তেমন প্রসারতা ছিলো না। তবে ইমামের বাবা ছিলেন আধুনিক মননশীলতার অধিকারী। ইমামের ভাষ্য মতে তার বাবা বই পড়তে ভালোবাসতেন এবং বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। এর সুফল সরূপই জাহানারা ইমাম শিক্ষা প্রাঙ্গণে সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন।

জাহানারা ইমামের শিক্ষাজীবন

জাহানারা ইমাম ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন কুড়িগ্রামে। এরপর নানা প্রতিকূলতার মধ্যে তার পড়াশোনা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্ত তার অদম্য ইচ্ছে শক্তি তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি নিজ বাড়িতে দুই জন গৃহশিক্ষক রেখে তার পড়াশোনা চালিয়ে যান। গৃহশিক্ষকদের উৎসাহ ও উদ্দিপনায় তিনি সাহিত্য চর্চায় অনুপ্রাণিত হন এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকদের বই পড়তে শুরু করেন। জাহানারা ইমাম সঙ্গীত ও সংস্কৃতির প্রতিও অনুরাগী ছিলেন। তিনি গ্রামোফোনে ইন্দুবালা, আব্বাসউদ্দিন প্রমুখএর গান শুনতেন।

শহীদ জননী জাহানারা মেট্রিক (মাধ্যমিক সার্টিফিকেট/SSC) পাস করেন ১৯৪২ সালে। এরপর তিনি ১৯৪৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক(HSC) পাস করেন ‘রংপুর কারমাইকেল কলেজ’ থেকে এবং ওই কলেজে তিনি সহ মোট তিন জন মুসলিম শিক্ষার্থী ছিলেন। এরপর তিনি চলে জান কলকাতায় এবং সেখানে ‘লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে’ ভর্তি হন ১৯৪৫ সালে।

‘লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে’ (২০১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়) থেকে ১৯৪৭ সালে বিএ(B.A.) পাস করেন। এরপর চলে আসেন ঢাকায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড(B.Ed) ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬০ সালে। বিএড ডিগ্রি অর্জন করে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে(USA) , সেখানে ১৯৬৪ সালে তিনি ‘সার্টফিকেট ইন এডুকেশন’ অর্জন করেন। এরপর পুনরায় ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বাংলায় এমএ(M.A.) পাস করেন ১৯৬৫ সালে।

আরো পড়ুনঃ লেখক সুফিয়া কামালের জীবনী

শহীদ জননীর বিয়ে

১৯৪৪ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়াশোনা করা কালীন সময়ে জাহানারার পরিচয় হয় শফিকুল আলাম ইমাম (শফিক ইমাম)এর সাথে,এরপর পরিণয় ৯ আগস্ট, ১৯৪৮ সালে। জাহানারা নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করেন এবং তার স্বামীও ছিলেন প্রতিষ্ঠিত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কর্মময় জীবন

জাহানারা ইমামের কর্মময় জীবন শুরু হয় শিক্ষকতার মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম শিক্ষকতা শুরু করেন ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ে একজন সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে। তিনি ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।

এরপর বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রায় ৫ বছর এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক হিসেবে ছিলেন ২ বছর। শহীদ জননী জাহানারা তার কর্মময় জীবনের কিছুসময় খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে।

স্বামী শফিক ইমামের সাথে ইমামের দাম্পত্য জীবন ছিলো মধুর ও সুখময়। শফিক ইমামের উৎসাহ ও উদ্দীপনায়ই স্ত্রী জাহানারা ইমাম হয়ে উঠেন একজন সফল নারী। তাদের ছিলো দুই ছেলে, শাফি ইমাম রুমী এবং সাইফ ইমাম জামী।

জাহানারা ইমামের জীবন ভালোই অতিবাহিত হচ্ছিলো, কিন্তু ছন্দপতন ঘটে তখন যখন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তার বড় ছেলে রুমী পাক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে শহীদ হন। এই শহীদ জননী  চেয়েছিলেন ছেলে আমেরিকা যাবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে।

কিন্তু সারা বংলায় যখন যুদ্ধের ঘনঘটা তখন রুমী বলেন-”আমেরিকা থেকে বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে হয়তো বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কখনো মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারবো না; তুমি কি তাই চাও আম্মা?”

তখন জাহানারা ইমাম ছেলের মহৎ উদ্দ্যেশের কাছে হেরে গিয়ে ছেলের যুদ্ধে যাওয়াই মেনে নিলেন। ১৯৭১ সালে রুমী মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে যোগদান করার সুবাদে জাহানারা সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন মুক্তিযোদ্ধদের। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস, চিকিৎসার জন্য ডাক্তার, ঔষধ, খাবারের জন্য অর্থ যোগান দেয়া সহ সার্বিক সহযোগিতার চেষ্টা তিনি করেছিলেন।

১৯৭১ সালে পাক-বাহিনী তার স্বামী এবং দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। ভয়ংকর অত্যাচার ও নিপিড়নের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত তার রুমী শহীদ হন। আর ক্ষত- বিক্ষত হয়ে ঘরে ফিরেন তার স্বামী এবং ছোট ছেলে জামী। কিন্তু শফিক ইমাম আর বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারেন নি। ছেলের শোকে বিজয় দিবসের দুই দিন আগে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনিও পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।

এক সন্তানকে বুকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকেন সংগ্রামী জাহানারা ইমাম। মুক্তি যুদ্ধে বিজয় অর্জন করার পর শহীদ রুমীর বন্ধুরা জাহানারাকে সকল শহীদের মাতা উপাধিতে ভূষিত করেন। আর এভাবেই একজন শহীদ রুমির মা থেকে লাখো শহীদের মাতা হওয়ার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন জাহানারা ইমাম। শহীদ জননীর অনবদ্য সৃষ্টি ‘একাত্তরের দিনগুলী’ ডায়েরিতে এসকল তথ্য তিনি তুলে ধরেছেন।

আরো পড়ুনঃ বেগম রোকেয়া সাখাওয়ার হোসেনের জীবনী

জাহানারা ইমামের রাজনীতিতে পথ চলা

ছাত্রজীবন থেকেই জাহানারা ইমামের রাজনীতির প্রতি ঝোঁক ছিলো, তবে ততটা প্রসারতা পায়নি। কিন্তু ২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে যখন জামায়াতে ইসলামী গোলাম আযমকে তাদের দলের আমীর ঘোষণা করে তখন থেকেই সক্রিয়ভাবে শুরু হয় শহীদ জননীর রাজনীতিতে পথ চলা।

গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামের আমীর ঘোষণা করার পর পরই সারা দেশে জনবিক্ষোভ শুরু হয়। আর সেই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন জাহানারা এবং ১৯ জানুয়ারী ১৯৯২ সালে তিনি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল’ কমিটি গঠন করেন।

১৯৯২ সালের ১১ ফেব্রয়ারি‘এর রেষ ধরেই ১৪টি ছাত্র সংগঠন, রাজনৈতিক জোট, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ,শ্রমিক- কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোট সহ মোট ৭০টি সংগঠন নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। তিনি সেই কমিটির আহ্বায়ক হন।

জাহানারা ইমাম গণআদালতে গোলাম আজমের ১০টি অপরাধ মৃত্যদন্ড যোগ্য বলে ঘোষনা করেন এবং রায় কয়ার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান। পরবর্তীতে ইমামের বিরুদ্ধে সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা হলে তিনি ১৯৯২ সালে ১২ এপ্রিল গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবিসংবলিত স্মারকলিপি জাতীয় সংসদে পেশ করেন। সংসদ অধিবেশনে ১০০জন সাংসদ জাহানারা ইমামের পক্ষে তথা গনআদালতের রায়ের পক্ষে সমর্থন দেন।

আরো পড়ুনঃ তসলিমা নাসরিনের জীবনী

জাহানারা ইমামের পুরষ্কার

এতোসবের মধ্য দিয়ে তিনি আবার সাহিত্য চর্চার জন্যও সময় বের করতেন। প্রাথমিকভাবে তিনি শিশু সাহিত্য ও অনুবাদ করতেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে তার ডায়েরি “একাত্তের দিনগুলি” প্রকাশিত হলে তিনি ব্যপক পরিচিতি লাভ করেন। তার জনপ্রিয় কিছু সাহিত্যকর্ম- ‘গজকচ্ছপ’, ‘সাতটি তারার ঝিকিমিকি’, ‘বীরশ্রেষ্ঠ’, ‘অন্যজীবন’, ‘জীবন-মৃত্যু’, ‘দুই মেরু’, ‘ক্যান্সারের সাথে বসবাস’ ইত্যাদি।

শহীদ জননী সাহিত্যে অবদানের জন্য ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার’, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরষ্কার’ এবং মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ‘স্বাধীনতা পদক’ সহ আরও আনেক পুরষ্কারে ভূষিত হন।

মৃত্যু

১৯৯৪ সালের ২৬ জুন, জাহানারা ইমাম ৬৫ বছর বয়সে ওরাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমণ করেন।

অবশেষে

জাহানারা ইমামের জীবন দর্শন, তার মহিমা, ত্যাগ বর্তমান প্রজন্মের হৃদয়ে এক জ্যোতিময় চেতনার সৃষ্টি করে। তিনি নিজেকে যেমন প্রদিপের সাথে তুলনা করেছিলেন, ঠিক তেমনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাঙ্গালীর অন্তরকে দীপ্তময় করে গেছেন। এই মহানুভব-মমতাময়ী শহীদ মাতার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।