You are currently viewing ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনী, জন্ম, বই, উক্তি। বিবিসির সেরা বাঙালি
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনী, জন্ম, বই, উক্তি। বিবিসির সেরা বাঙালি

বাঙালি, বাংলাদেশি তথা ভারতীয় উপমহাদেশের মহাব ব্যক্তিত্ব, বহুভাষাবিদ, বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক ছিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। মহাব এই গুণী মানুষটি জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায়। পেয়ারা নামক গ্রামে তার জন্ম। তার পিতার নাম ছিল মফিজউদ্দীন আহমদ এবং তিনি পেশায় ছিল পীর গোরাচাঁদের দরগাহর খাদেম । তার মাতার নাম হুরুন্নেসা। ২০০৪ সালের বিবিসি বাংলার জরিপে শীর্ষ ২০ বাঙালির তালিকায় ১৬তম স্থানে রয়েছেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শিক্ষাজীবন

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের এক মক্তব থেকে। তারপর হাওড়া জেলা স্কুল থেকে, সেখান থেকে তিনি এন্ট্রান্স পাস করেন ১৯০৪ সালে। তারপর তিনি সফলতার সাথে এফ.এ (বর্তমান এইচএসসি’র সমমান) পাশ করেন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে সম্মান-সহ বি.এ পাস করেন ১৯১০ সালে। ১৯১২ সালে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ ডিগ্রি অর্জন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মহান এই শিক্ষাবিদ ১৯২৮ সালে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন প্যারিসের একটি বিশ্ববিদ্যাল্য থেকে।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কর্মজীবন

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একাধিক ভাষা শিক্ষা গ্রহ্ণ করেন। প্রায় ২৪টি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তার মধ্যে ১৮টি ভাষার ওপর তার উল্লেখযোগ্য পাণ্ডিত্য ছিল। যখন তিনি এন্ট্রান্স পাস করেন তখন থেকে তিনি একাধিক ভাষা শিখতে শুরু করেন। কর্মজীবনের শুরুতে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯০৮ সাল থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা করেন। প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৫ সাল শিক্ষকতা করেন সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে।

তিনি চব্বিশ পরগণার বসিরহাটে আইন ব্যবসা করেন ১৯১৫ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত। তিনি বেদ পাঠের সুযোগ পান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং সেখানে তিনি ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেনের সহকর্মী হিসেবে গবেষক হিসেবে কাজ করেন ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত । তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে প্রভাষক ও আইন বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। 

পরবর্তীতে তিনি ১৯৩৭ সালে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও রিডার হিসেবে নিযুক্ত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ১৯৪৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর তিনি বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ফরাসি ভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও পালি বিভাগে যোগ দেন ১৯৫৫ সালে এবং অবসর গ্রহণ করেন ১৯৫৮ সালে।

তিনি সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন উর্দু ভাষার অভিধান প্রকল্পে এবং পূর্ব পাকিস্তানি ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। তিনি বাংলা একাডেমির ইসলামি বিশ্বকোষ প্রকল্পের অস্থায়ী সম্পাদক হিসাবে ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত কাজ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলা একাডেমির পঞ্জিকার তারিখ বিন্যাস কমিটির সভাপতি ছিলেন এবং তার নেতৃত্বে পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাহিত্য

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সাহিত্য ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ ছিল। তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক ও তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন ১৯৪৮ সালে। তার ইত দীর্ঘ জীবনে তিনি অনেক বই লিখেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যের কথা (২ খণ্ড), ইসলাম প্রসঙ্গ, রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম, বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত, মহররম শরীফ, টেইল ফ্রম দি কুরআন, দীওয়ানে হাফিজ, নবী করিম মুহাম্মাদ, ব্যাকরণ পরিচয়, বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, বিদ্যাপতি শতক, বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, Hundred Sayings of the Holy Prophet, Buddhist Mystic Songs (১৯৬০)। তার ধর্মীয় গ্রন্থসমূহ দেখলেই বোঝা যায় তিনি কতটা ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন।

তিনি লেখালেখির পাশাপাশি ইসলামের প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরার জন্য গ্রামে-গঞ্জে ওয়াজ-মাহফিলে অংশ গ্রহণ করতেন। যখব ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালে, প্রথম ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে কঠোর প্রতিবাদ করেছিলেন।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পুরস্কার

উপমহাদেশের স্মরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্ব ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ লাভ করেন ১৯৬৭ সালে। নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স পদক পায় ১৯৬৭ সালে ফ্রান্স সরকার কতৃক। তাকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধিতে ভূষিত করেন ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ। তাকে ‘ প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পদক’ ও মরণোত্তর ‘হিলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব’ প্রদান করা হয় পাকিস্তান শাসন আমলে। মরণোত্তর ‘ডি. লিট’ উপাধি পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক দেয় ১৯৮০ সালে।

ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যু

চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া নামে পরিচিত এই মহান মনীষী বাংলাদেশের ঢাকায় ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন এই মহান ব্যক্তি। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের পাশে সমাহিত করা হয়। তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল সে বছরই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কলা ভবনের নামকরণ করা হয় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নামে তাকে সম্মান জানাতে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ একাধারে শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক, আইনজীবী, অনুবাদক, কবি, সাহিত্যিক, লোকবিজ্ঞানী, দার্শনিক, জ্ঞানতাপস ও ভাষাসৈনিক হিসেবে সকলের মাঝে সমানভাবে প্রিয় ছিল।