You are currently viewing বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামালের জীবনী ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান
শেখ জামাল

বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামালের জীবনী ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান

শেখ জামাল ছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র।১৯৭১ সালে দেশে যখন মুক্তি যুদ্ধ চলছিল তখন মুজিব পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো তিনিও গৃহবন্দী ছিলেন। গৃহবন্দি থাকার কিছুদিন পর তিনি সেখান থেকে চলে আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারপরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।শেখ জামাল ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। 

এক নজরে শেখ জামাল

মূল নামঃ শেখ জামাল

ডাকনামঃ জামাল

জন্মঃ ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল

জন্মস্থানঃ টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ

বসবাসঃ ৩২ নাম্বার ধানমন্ডি

বৈবাহিক অবস্থানঃ বিবাবিত

স্ত্রীঃ পারভিন রোজী

বাবাঃ শেখ মুজিবুর রহমান

মাতাঃ শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব

ভাইঃ শেখ কামাল

ছোট ভাইঃ শেখ রাসেল

বড় বোনঃ শেখ হাসিনা

ছোট বোনঃ শেখ রেহানা

দাদাঃ শেখ লুৎফর রহমান

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃ ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ ও ঢাকা কলেজ

যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরেনঃ ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর

উপাধিঃ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন, মুক্তিযুদ্ধা

ধর্মঃ ইসলাম

চোখের কালারঃ কাল

চুলের কালারঃ কাল

জাতীয়তাঃ বাংলাদেশী

মৃত্যুঃ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট

মৃত্যুর স্থানঃ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে

নিহত হনঃ সেনাবাহিনীর ধারা

শেখ জামালের ব্যক্তিগত জীবন

শেখ জামাল জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৪ সালের ২৮ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলার টুংগীপাড়া গ্রামে। তার পড়াশোনা শুরু হয় ঢাকাতেই। তিনি ম্যাট্রিক (এস এস সি) পাস করেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে। তারপরে তিনি স্কুল পরবর্তন করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে জামাল ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। 

জামালের আরও একটি প্রতিভা ছিলো সেটি হচ্ছে তিনি ছোটবেলা থেকেই অনেক ভালো ক্রিকেট খেলতেন।তাছাড়া ছোটবেলায় তার গিটার শেখার আগ্রহ ছিল যার জন্য তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন।শেখ জামালের দাম্পত্য সঙ্গী ছিলেন পারভিন রোজি।

শেখ জামালের মুক্তিযুদ্ধকালীন জীবন

শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।১৯৭১ সালের ১২ই মে জামাল সহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কে গ্রেপ্তার করে গৃহবন্দি করে রাখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।

তারপরও তিনি সেই গৃহবন্দি অবস্থা থেকে পালিয়ে যান এবং পরবর্তীতে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন।তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সএস যার নাম পরবর্তীতে বদল করে রাখা হয় মুজিব বাহিনী সেটাতে যোগদান করেন।

সেখানে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে জামাল তাদেরকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কি কি করতে হবে সে সম্পর্কে সবাইকে বলেন।

মুক্তিযুদ্ধ যত দিন চলেছিল তিনি ততদিন সেই ফোর্সের বা বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলেন এবং তাদেরকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতেন। 

পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান যখন পশ্চিম পাকিস্তানকে হারিয়ে মুক্তি যুদ্ধে জয় লাভ করে এবং বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত লাভ করে তখন শেখ জামাল ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাড়িতে ফিরে আসেন।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে শেখ জামালের অবদান

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নির্মাণের জন্যে স্বাধীনতার পরবর্তীতে জামাল ঝাপিয়ে পড়েন অবকাঠামো নিমার্ণে। কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দেশের প্রায় সকল বড় অবকাঠামো তছনছ করে গিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে দেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল যাতে দেশ অচল হয়ে পড়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দিশে এই দেশ খুব তাড়াতাড়ি মাথা তুলে দাড়িয়েছিল স্বল্পভাষী, স্থির, অত্যন্ত মেধাবী এবং দেশপ্রেমিক শেখ জামালদের অবদানের কারণে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন জামাল তোমার মৃত্যু নাই, আছো তুমি আমাদের সকলের হৃদয়ের গভীরে। জয় বাংলা।

শেখ জামালের সেনাবাহিনীতে যোগদান

শেখ জামাল ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ অফিসার।তার সেনাবাহিনীতে যোগদানের পিছনে অনেক গল্প রয়েছে।১৯৭৪ সালের ২৯ শে জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় সফরে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বাংলাদেশে আসেন প্রথমবারের মতো। 

তারপরে তিনি শেখ জামালের মধ্যে সেনাবাহিনীতে যোগদান করার প্রবল আগ্রহ দেখতে পান। আর সেই কারণেই তিনি তাকে যুগোস্লাভ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ করার জন্য প্রস্তাব দেন। 

তারপর তিনি ১৯৭৪ সালে যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।তবে সেখানে যোগদান করার পর তার অনেক ধরনের অসুবিধা হয়। 

সেখানকার ভিন্ন পরিবেশ, প্রতিকূল আবহাওয়া, আর মূলত ভাষার অসুবিধার কারণে সেখানকার প্রশিক্ষণের সাথে তাকে খাপ খাইয়ে নিতে অনেক কষ্ট হয়।

শেখ জামালের এই পরিস্থিতি দেখার পর মার্শাল টিটো ক্যাপ্টেন জামালকে বৃটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

সাধারণত বৃটেনের এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা সামরিক প্রশিক্ষণ একাডেমী। জামাল ১৯৭৪ সালের শরৎ মাসে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য লন্ডনে পৌঁছান।

তবে সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার আগে লন্ডনের এই প্রশিক্ষণ একাডেমী কিছু শর্ত ছিল যেগুলো জামালকে পূরণ করতে হয়। যেমন সেই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার আগে অবশ্যই ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হতে হবে।

তারপরও তিনি সমস্ত শর্তসাপেক্ষ পূরণ করে সেখানে প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তুত হন।স্যান্ডহার্স্টে সর্বপ্রথম ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী অফিসারদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়।

লন্ডন শহরের ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত স্যান্ডহার্স্ট। জামাল যেই সময় প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য গিয়েছিলেন তখন স্যান্ডহার্স্টের কমান্ড্যান্ট ছিলেন জেনারেল রবার্টফোর্ড।

তারপরে ১৯৭৫ সালের ২৭ জুন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে মিলিটারি কোর্স পাসিং আউট প্যারেড। সেখানে বিদেশি ক্যাডেটদের মধ্যে ৩ জন তরুণ বাংলাদেশ থেকে কমিশন লাভ করেন।তার মধ্যে শেখ জামাল ছিলেন একজন। 

তার পরে ক্যাপ্টেন জামাল ১৯৭৫ সালের ১ আগস্ট স্যান্ডহার্স্টে রেগুলার ক্যারিয়ার কোর্স শুরু হওয়ার কথা থাকলেও জামাল সে করছে অংশগ্রহণ করেননি। 

কেননা তার দুই বন্ধু সেই সময়ে আবার দেশে ফিরে আসলেন আর ক্যাপ্টেন জামালের পরিবারের প্রতি ছিল অনেক টান সেই কারণে তিনি কোর্স করেননি। 

তিনি সেখান থেকে ফিরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পোস্টিং হলো ঢাকা সেনানিবাসের দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গলে। তিনি প্রায় দেড় মাস চাকরি অবস্থায় ছিলেন। তারপরে আস্তে আস্তে জামাল তাদের মধ্যে একজন কমিশনপ্রাপ্ত সেনা অফিসার হয়ে ওঠেন। 

শেখ জামাল ব্যক্তি হিসেবে কেমন ছিলেন

শেখ জামাল ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন একজন অসাধারণ মানুষ। তিনি ছিলেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় পুত্র।

যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি বাংলাদেশের হয়ে সংগ্রাম করে গিয়েছেন। তার স্পষ্ট প্রমাণ হাজার ১৯৭১ সালে তার পরিবারের সকল সদস্য যখন গৃহবন্দী ছিলেন তখন ক্যাপ্টেন জামাল পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধের তিনি মুজিব বাহিনীতে যোগদান করেন এবং সেখান থেকে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সকল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে। তাদেরকে তিনি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়ার মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে উদ্বুদ্ধ করেন।

যুদ্ধ শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত জামাল সেই বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলেন। ক্যাপ্টেন জামাল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং দেশের সেবা করতে শুরু করেন।

শেখ জামাল সকল সময় দেশের কল্যাণের জন্য কাজ করে গিয়েছেন। দেশের সেবায় সকল সময় তিনি নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছেন।দেশের জন্য সংগ্রাম করে গিয়েছেন সারা জীবন। তাই বলা যায় জামাল মানুষ হিসেবে ছিলেন একজন অসাধারণ ব্যক্তি। 

শেখ জামালের মৃত্যু

শেখ জামাল মৃত্যুবরণ করেন হাজার ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে।শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে জামালকে সপরিবারে হত্যা করা হয় হাজার ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট।

ক্যাপ্টেন জামাল সহ তার পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করে সেনাবাহিনীর এক ইউনিট। এটি ছিল আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়ংকরতম এবং ন্যক্কারজনক এক হত্যাকাণ্ড।

শেখ জামালকে সহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় এই দিনে। যা ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে সারা জীবন লেখা হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ইতিহাসে।