You are currently viewing শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ইতিহাস এবং কেন পালন করা হয়
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ইতিহাস এবং কেন পালন করা হয়

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস – যেটি জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় প্রত্যেক ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখ। অর্থাৎ আমরা প্রত্যেক ১৪ ই ডিসেম্বর জাতীয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করে থাকি। তবে ২০২১ এর শেষে এসেও অনেকে জানে না এই দিনটির তাৎপর্য কতটা বা তারা জানেন না আসলে এই দিনটির পিছনে মূল কাহিনী কি। কেন দেশে প্রতি ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে এতটা শ্রদ্ধার সহিত এই দিনটি পালন করা হয়।

যদি এখনও পর্যন্ত আপনি এই দিনটির তাৎপর্য না জানেন, তাহলে আপনি অনেক পিছিয়ে রয়েছে। একজন বাঙালি বা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার সুবাদে আপনার অবশ্যই ১৪ ই ডিসেম্বর এর ঘটনা সম্পর্কে জানা দরকার। আজকের আর্টিকেলে আমি যতটা সহজ করে হোক, আপনাদের এই দিনটির পুরো গল্পটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করবো। আর্টিকেলটা পুরো পড়লে আশা করছি আপনারা কেউ এই দিনটির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে অন্তত কয়েক লাইন বলতে পারবেন।

‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ – যেটি বাংলাদেশে পালিত একটি বিশেষ দিন। বাংলাদেশে প্রতি বছরের ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ দিনটিকে বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থেকে। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে সময়টাতে পাকিস্থানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর সকল বুদ্ধিজীবীকে নির্বিচারে হত্যা করে। আর এই কজে বাংলাদেশীদের মধ্যে রাজাকার আল বদর, আল সামস বাহিনীর সদস্যরা তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুইভাবেই সাহায্য করেছিল।

এই দিবসের প্রেক্ষাপটে গেলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়ের প্রাক্কালে পাকিস্থানি সেনা এবং তাদের সাথে রাজাকার বাহিনী মিলিত হয়ে বাংলাদেশের অসংখ্য শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, গবেষক, সাংবাদিক, প্রফেসর, প্রৌকশলী, শিল্পী এবং কবি সাহিত্যিক দের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্বিচারে অত্যাচার এবং অত্যাচারের পর হত্যা করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের প্রাক্কালে থাকায়, এ দেশকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত ভাবেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। পরবর্তীতে ঢাকার মিরপুর, রাইবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গণ কবরে তাদের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল।

বুদ্ধিজীবী কারা?

২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, বুদ্ধিজীবিদের সংজ্ঞা চূড়ান্ত করা হয়। সেই সংজ্ঞা অনুসারে বলা হয় বুদ্ধিজীবী কারা সেটা। বলা হয়েছিল, যারা ১৯৭১ সালের ২৫ ই মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়ে বাঙালি সাহিত্যিক, কবি, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, শিল্পী, শিক্ষক, সাংবাদিক, গবেষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রৌকশলী, বস্কর, সরকারি এবং বেসরকারি কর্মচারী কিংবা রাজনৈতিক সমাজসেবী, সংস্কৃতি সেবি, চলচ্চিত্র নাটক ও সংগীত এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ঊর্ধ্ব ভিত্তিক কর্মকাণ্ডের সাথে বাংলাদেশ এর  যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ খাতে অবদান রেখেছিল এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্থানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ হয়েছিল তারা অথবা ঐ সময় যারা সবসময়ের জন্য নিখোঁজ হয়েছিল তাদেরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য করা হবে। তাসের স্মরণেই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়।

বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এর মূল কাহিনী কি ছিল?

এতক্ষণ আমরা জানলাম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস মূলত কি এবং কারা এই বুদ্ধিজীবী। তবে এই দিনটির পেছনে কী গল্প রয়েছে সেটাই এখন জানবো আমরা। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন পাকিস্থানি বাহিনীরা ধরে নিয়েছিল যে তাদের আত্মসমর্পণ করতেই হবে তাদের হার নিশ্চিত তখনই ঠিক তার দুদিন আগে অর্থাৎ ১৪ ই ডিসেম্বর রাতের আঁধারে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তারা নির্বিচারে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করেছিল।

হোয়াইট হাউস থেকে ফাঁস হওয়া বিভিন্ন টেপ এবং ডকুমেন্ট এর মধ্যে দেখা যায় হেনরি কিসিঞ্জার এর খুবই অদ্ভুত এক পদক্ষেপ এর কারণে পাকিস্থানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কার্যক্রমটি দেরি করা হয়। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবীদের এত বড় ধরনের একটা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা সম্বব হয়েছিল।

মূল ঘটনা হচ্ছে ডিসেম্বরের ৯ তারিখ জেনারেল ইয়াহিয়া খান স্ট্যান্ড কমান্ডে গভর্নরকে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বলে, এবং এর পর থেকে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু ১১ তারিখে হটাৎ ইয়াহিয়া খানের আরো একটি টেলিগ্রাম আসে যেটি ঠিক এমন ছিল;

Do not, Repeat,
Try not to make any move on my Last message to you. Vital political and military moves are occurring by our Friends.

৯-১১ তারিখের মধ্যে যা হয়েছিল সেটি হলো, ম্যানহাটন, নিউ ইয়র্ক এর পূর্ব দিকে একটা সেভ হাউজে হেনরি কিসিঞ্জার এবং চায়না তৎকালীন জাতিসংঘের পার্মানেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ হুয়াং হুয়া এর মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

তাদের ফাঁস হওয়া কনভারসেশন এর মধ্যে দেখা যায়, হেনরি কিসিঞ্জার মরিয়া হয়ে চিন কে এটা বলে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করতেছে যে, তারা যাতে ইন্ডিয়ার বর্ডারে আক্রমণ চালায় এতে বাংলাদেশ এবং পাকিস্থানের মধ্যেকার যুদ্ধটি এটা আঞ্চলিক যুদ্ধ থেকে বিশ্ব যুদ্ধে পরিণত হবে। এতে পাকিস্থান এর পরাজয় তাড়াতাড়ি ঠেকানো যাবে। শুধুমাত্র এমন এক ধরনের মেসেজ এর কারণে পাকিস্থান আর্মির যে আত্মসমর্পণ সেটি পিছিয়ে যায়, অর্থাৎ দেরি করা হয়। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ই ডিসেম্বরের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড পাকিস্থান করতে সক্ষম হয়।

শেষ পর্যন্ত দেখা যায় ইন্ডিয়ার বর্ডারে চায়না কোনো আক্রমণ করেনি। কিন্তু ১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্থানি বাহিনী আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছিল, যেটা তারা আরো আগেও চাইলে করতে পারতো।

তথ্য সূত্রঃ Enayet Chowdhury (YT)

বাংলাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কি?

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বা বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তো অনেক কিছুই জানলাম, কিন্তু এই দিনটি আমরা কেন এত শ্রদ্ধা ভরে পালন করি তা আছে আছে সবার জানা? বলতে পারেন আমাদের এই স্বাধীন দেশে স্বাধীন পতাকা উড়ানোর পেছনে তাদেরও অবদান আছে। বর্তমান দিনে দেশ কিভাবে স্বাধীন হয়, মুক্তিযুদ্ধের আসল কাহিনী কি এসব বিষয়ে শুনতে কতজন এইবা আগ্রহী হয়।

তবে যাদের মৃত্যুর উপহার হিসেবে আমরা এই দেশে আজ শান্তির সহিত বাস করছি তারাই হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবীরা। নানানভাবে যুদ্ধ না করলেও মুক্তিযুদ্ধদের তারা সাহায্য করে গিয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের অবদান ছিল অতুলনীয়। মেধা, পরিশ্রম সবকিছু দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পেছন থেকে যুদ্ধ করার শক্তি যুগিয়েছেন তারা।

যাঁরা দেশ স্বাধীন করার জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছেন তারা সারাজীবন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বুদ্ধিজীবীরাও তাই সারাজীবন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ চিন্তা, অর্থ, মেধা, শ্রম, বুদ্ধি ,পরামর্শ দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধাদের যুদ্ধের অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের মতো দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও যাতে তাদের মেধা এবং শ্রম পেতে না পারে তাই তাদের নির্বিচারে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হাত পা বেঁধে হত্যা করা হয়। তাই ১৪ ই ডিসেম্বরের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সহিত এ দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া সকল বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করা হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে শহীদে দের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা করা এবং সম্মান নিবেদন করা।

শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা কত?

১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জাতীয় ভাবে প্রকাশিত হওয়া শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজউইক এর সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিনের লেখা থেকে জানা যায় যে সর্বমোট শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবিদের সংখ্যা ছিল মোট ১০৭০ জন। তবে একটি সরকারি ডকুমেন্টারি রয়েছে যার নাম হলো ‘Bangladesh’, সেখানে বলা হয় বুদ্ধিজীবী এর সংখ্যা ছিল ১১০৯ জন যারা শহীদ হোন।

তবে যুদ্ধ বিশেষজ্ঞদের মতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি। ১৯৭২ সালের দিকে এই কাজের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়, যেটির মাম ‘বুদ্ধিজীবী নিধন তথ্যানুসন্ধান কমিটি’ ,তাদের প্রাথমিক তালিকা অনুসারে প্রায় ২০ হাজার জন বুদ্ধিজীবীকে লিস্ট করা হয়। বিভিন্ন কারণে আসলে এই তালিকাটি সঠিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।

উপসংহার

আমরা সবাই ১৪ই ডিসেম্বর এর মর্মান্তিক ঘটনাটি সম্পর্কে জানতে পেরেছি, জানতে পেরেছি এ দেশকে স্বাধীন ভাবে প্রতিষ্টা করতে তাদের আত্মত্যাগ এর কথা। তাই আমাদের সবাই উচিত প্রতি বছর ১৪ই ডিসেম্বর বা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করা এবং সম্মানের সহিত দিনটি উদযাপন করা। তাহলেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের থেকে দেখে তারাও এই দিনটিকে শ্রদ্ধার সহিত পালন করবে।