You are currently viewing ১৬ ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের ইতিহাস
বিজয় দিবস

১৬ ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের ইতিহাস

দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হয় একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ, বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ২২শে জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ দিনটিকে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের সর্বত্র পালন করা হয়। বিজয় দিবস বাংঙালীর এক চেতনার নাম।

বিজয় দিবস এমনি এমনি আসেনি। এর পেছনে রয়েছে ৩০ লক্ষ বাঙালি নরনারীর ত্যাগ এর ইতিহাস। তবে এর সুত্রপাত হয় ১৯৪৭সালে যখন ব্রিটিশ সরকার ভারতকে স্বাধীনতা দেয়। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশকে বিভক্ত করে দেয় দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রে, ভারত ও পাকিস্তান। যেখানে পাকিস্তানের ভূখণ্ডের একটি অংশ থাকে মূল ভূখণ্ড হতে ১২০০ মাইল দূরে, যার নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান ও মূল ভূখণ্ডের নাম হয় পশ্চিম পাকিস্তান।

পাকিস্তানের শোষণ ও শাসন

পাকিস্তানের ভূখণ্ড পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে দুটি ভিন্ন ভূখণ্ডে হলেও এর শাসনকার্য পরিচালিত হতো মূল ভূখণ্ড অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান হতে। কিন্তু তা শাসন না বলে শোষণ বললে বেশি ভাল হবে। কারন এ শাসন ব্যবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের জন্য ছিল বিশাল সুযোগ এবং পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য ছিল বঞ্চনা। পূর্ব পাকিস্তানিরা তাদের ন্যায্য অধিকার টুকুও পেতনা। এর মূলে ছিল বৈষম্য, অধিকার আদায়ে বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, চাকরীর ক্ষেত্রে বৈষম্য, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য অস্বীকারের মত বিশাল বৈষম্য।

অন্যায়ের প্রতিবাদ

পূর্ব পাকিস্তনিদের শোষণের বিরুদ্ধে অনেকবার বিরধিতা করা হলেও তা অতটা জোরদার ছিলনা। কিন্তু এ প্রতিবাদ জোরদার হয় যখন টা মাতৃভাষায় আঘাত হানে। পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলা থাকা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান ১৯৪৮সালের ২১শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা দেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তান এর রাষ্ট্রভাষা ‘। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আরেক সভায় যখন তিনি ঘোষণা করেন, ‘ সরকারি কাজে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করা হলেও রাষ্ট্রভাষা হবে শুধুমাত্র উর্দু’ তখন ছাত্র জনতা না! না! কণ্ঠে হুংকার করে উঠে।

এর পেছনে কারন ও ছিল বটে, এ সময় ডাকটিকিট, ফর্ম, ট্রেনের টিকিট এমনকি মুদ্রায় ও ছিল শুধু ইংরেজি ও উর্দু, কথাও বাংলার কোন নাম গন্ধ ছিলনা। তাই না! না! বলা থেকেই প্রতিবাদ গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘরে ঘরে।এ প্রতিবাদ যুদ্ধে রূপলাভ করে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাতের পর থেকে।

মুক্তিযুদ্ধে আহ্বান

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ইতিহাসে কালোরাত বলে খ্যাত। এ দিন পাকবাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গালির ওপর ঝাঁপিয়ে পরে।প্রতিবাদ দমনে পাকবাহিনী গণহত্যায় মেতে উঠে। নির্মম ভাবে হত্যা করে বাঙ্গালিদের। এর পরই ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তিনি ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে সকল বাঙ্গালিকে আহব্বান জানায় এবং স্বাধীনতার ডাক দেন।

বিজয় দিবস

মুক্তিযুদ্ধ

পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫শে মার্চের হত্যাযজ্ঞ দেখে বাঙালি আর থেমে থাকতে পারেনি। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এ যুদ্ধ দীর্ঘ ৯ মাস চলে। এ যুদ্ধে বাঙ্গালির অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাঙালি হারায় জাতীয়তাবাদী নেতা, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মকর্তা – কর্মচারী , পুলিশ ও কত শত মা বোনের সম্ভ্রম। এত কিছুর বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা।

মুক্তিযুদ্ধে বহিঃবিশ্বের সহায়তা

বাঙালি আমজনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন করে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ সময় বীর বাঙ্গালি সেনাদের গেরিলা যুদ্ধ , প্রলয়ঙ্করী ট্যাঙ্ক যুদ্ধও হয়। এ সময় বাংলাদেশকে সাহায্য করে ভুটান, ভারত ও বহিঃবিশ্বের গণমাধ্যম। ভুটান বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় এবং ভারত বাংলাদেশকে প্রশিক্ষণ ,সেনা সদস্য, যুদ্ধ সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করে। পাশাপাশি ভারত ১ কোটি শরণার্থী কে জায়গা দেয়। বহিঃবিশ্বের আরও বাংলাদেশকে সহায়তা করে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম বিশ্বের সকলের সামনে পাকিস্তানি বাহিনির নির্যাতন তুলে ধরে যা বহিঃবিশ্বে জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এতে সকলে বাংলাদেশকে সমর্থন করে এবং তা মুক্তিযুদ্ধকে তরান্বিত করে।

পাক-বাহিনির পিছুহটা

বাঙালি সেনাদের সাথে যখন ভারতীয় সেনা সদস্য এবং অস্ত্র বহর যুক্ত হয় তখন পাকিস্তানি বাহিনী নড়ে চড়ে ওঠে। তখন তারা তাদের হার নিশ্চিত বুঝতে পারে এবং ধীরে ধীরে পিছু হটতে শুরু করে। এবং এক পর্যায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

আত্মসমর্পণ

দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের দলিলে সই করে। এ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি, যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে ছিলেন যৌথবাহিনীর প্রধান জগজিৎ সিং আরোরা, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খোন্দকার। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঠিক বিকাল ৪টা ৩১মিনিটে জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন। এ দলিলের নাম ছিল “ INSTRUMENT OF SURRENDER”।

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জন্ম হয় বাংলাদেশ নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু বিজয়ের আগেই অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৮শে এপ্রিল ইসরাইল বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয়। তবে বাংলাদেশ তা গ্রহন করেনি।কারন ইসরাইল ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে শোষণ করে। যদিও এ স্বীকৃতিতে ইসরাইল এর স্বার্থ রয়েছে। যার কারনে বাংলাদেশ এ স্বীকৃতি ত্যাগ করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিজয়লাভের আগেই ৬ই ডিসেম্বর ভুটান ও ভারত বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দেয়।

যুদ্ধে জয় লাভের পর ১২ জানুয়ারি পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া স্বীকৃতি দেয়, ১৩ জানুয়ারি বার্মা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, ১৬ জানুয়ারি নেপাল ও পরবর্তীতে অন্যান্য দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে কমন ওয়েলথ অব নেশনস এর সদস্য পদ লাভ করে।সর্বশেষ ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্থান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

বিজয় দিবস উদযাপন

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস। বিজয় দিবস প্রতিটি বাঙ্গালির জন্য এক বিশেষ দিন। তাইতো আজ ৫০ বছর পরও ধুমধাম করে বিজয় দিবস পালন করা হয়। এ দিনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়ে থাকে, যেখানে উপস্থিত থাকেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।দেশের প্রধান সড়ক গুলো সজ্জিত হয় রাষ্ট্রীয় সাজে। এ দিন বাংলার আকাশে বাতাসে লাল সবুজের পতাকা দেখা যায়।

এছাড়াও বিজয় দিবসে অনুস্থিত হয় বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান, মতবিনিময় সভা,সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়াও প্রাইমারী স্কুল গুলোতে অনুস্থিত হয় চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। এ দিনকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হয় চলচিত্র,নাটক, টেলিফিল্ম আরও কতো কি। বাংলার আনাচে কানাচে চলে বিজয়মেলা। এ দিনকে কেন্দ্র করে আরও অনেক বিশাল বিশাল আয়োজন করা হয়। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার ফলে আমরা এ দিনটি পাই। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাঙালিজাতি তথা বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। বাংলার ইতিহাসে এ দিনটি একটি বিশেষ দিন।যুগের পর যুগ ধরে বাঙালি মনে রাখবে এ বিজয়গাঁথা।