You are currently viewing মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাংলাদেশ
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাংলাদেশ

বাংলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিছক ইতিহাস নয়। এর পিছে রয়েছে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার গল্প। রয়েছে কত মায়ের ছেলে হারানোর গল্প রয়েছে কত বোনের ভাই হারানর গল্প। ৩০লক্ষ্য বাঙ্গালির রক্তের ইতিহাসই বাংলার ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের সুত্রপাত ভারত পাকিস্তানের বিভক্তের মাধ্যমে হয়।

পাকিস্তানের জন্মঃ ১৯৪৭ সালে অবসান ঘটে ব্রিটিশ অধিরাজ্যের। অবসান ঘটে ব্রিটিশ রাজ শাসন বা ক্রাউন শাসনের। জন্ম হয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্রের। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট এ দেশ দুটি আইনত অস্তিত্ব লাভ করে। পাকিস্তানের একাংশ ছিল মূল ভূখণ্ড হতে ১২০০ মাইল দূরে, যার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এবং মূল ভূখণ্ডের নাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের জনসংখ্যা সমান সমান থাকা সত্তেও শাসনকার্য ছিল পশ্চিমাংশের হাতে। আর এ থেকেই বৈষম্যের খাতা খুলে যায়। আর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে ক্ষোভের দানা বাঁধতে শুরু করে।

পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার ক্ষুণ্ণ- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছিল কৃষিখাত সমৃদ্ধ আর পশ্চিম পাকিস্তানের নজর ছিল শিল্পায়ন ও নগরায়নের দিকে। দেশের রপ্তানি খাতে ৭০% অর্থনৈতিক অবদান ছিল পূর্ব পাকিস্তানে যেখানে উন্নতির খাতে বরাদ্ধ ছিল মাত্র ২০% অর্থ। পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত চাল পূর্ব পাকিস্তানে বিক্রি হতো ৫০ টাকা দরে যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে বিক্রি হতো ২০ টাকা দরে। শুধু তাই না আটা, সরিষা ইত্যাদি পূর্ব পাকিস্তান উৎপাদিত হলেও বিক্রি মুল্য পূর্ব পাকিস্তানে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের দিগুণ।

আবার বৈদেশিক সাহায্যের ৮০ শতাংশ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে ও ২০ শতাংশ ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে। উন্নয়ন খাতেও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্ধ ছিল ৩০০০ কোটি টাকা যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্ধ ছিল ৬০০০ কোটি টাকা। শুরুতে পশ্চিম পাকিস্তানে কলকারখানা ছিল ৯ টি ও পূর্ব পাকিস্তানের ১১ টি সেখানে তা কয়েক বছর পর পশ্চিম পাকিস্তানে দাড়ায় ১৫০ টি তে এবং পূর্ব পাকিস্তানের দাড়ায় মাত্র ২৬ টিতে । চাকরি ও প্রশাসনিক খাতেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্য ছিল বেশি। পূর্ব পাকিস্তানিরা বিরোধিতা করেনি সকল কিছুর পরও ।

কিন্তু যখন ১৯৪৮ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা তখনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগন প্রতিবাদ জানান। এ সময়ের মুদ্রা, ডাকটিকিট, ট্রেনের টিকিট ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই ব্যবহার হতো উর্দু এবং ইংরেজি। বাঙ্গালির অস্তিত্ব বলতে বাংলা ভাষাই ছিল। তাইতও সকল বৈষম্য মানতে পারলেও নিজেদের অস্তিত্ব হারানোর কথা কোনো ভাবেই মানতে পারেনি বাঙালি তথা পূর্ব পাকিস্তানিরা। এ সময় ইসলামি মনোভাব রাখে এমন কিছু মানুষ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর কথায় সায় দিলেও অধিকাংশ মানুষ দ্বিমত প্রকাশ করে।

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম দাবী- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী তৎকালীন পাকিস্তানি গণপরিষদের সদস্য ধিরেন্দ্রনাথ দত্ত ১ম বারের মত গণপরিষদের অধিবেশনে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলায় বক্তব্য় রাখেন এবং অধিকাংশ জনসংখ্যার ভাষা বাংলা কে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান। একাধিক রাষ্ট্রভাষা নিয়া দেশ এগুতে পারবেনা বাহানায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ দাবী নাকচ করেন।

২৬ শে ফেব্রুয়ারী আন্দোলন

 ২৫শে ফেব্রুয়ারী সংগঠিত অধিবেশনের প্রেক্ষিতে ২৬শে ফেব্রুয়ারী ছাত্র, বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা, ক্লাস বর্জন করে ধর্মঘট করে। সেখানে ১১ মার্চ ধর্মঘট ডাকা হয়।

খাজা নাজিমুদ্দিনের চুক্তি পত্রে সাক্ষর- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

১১ তারিখের আন্দোলনের পর ১২-১৫ মার্চ ধর্মঘট পালন করা হয়। এ আন্দোলনের এক পর্যায় সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠকে বসেন খাজা নাজিমুদ্দিন এবং সমঝতার মাঝে ৮ টি বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চুক্তি পত্রে সাক্ষর করেন। এ চুক্তি পত্রে সাক্ষরের মূল কারন ছিল ১৯শে মার্চ জেনারেল মুহাম্মদ আলি জিন্নাহের ঢাকা সফরের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি। যদিও তারা পরবর্তীতে এ চুক্তিপত্র অস্বীকার করে।

জেনারেল মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ এর ঢাকা সফর

জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ শে মার্চ প্রথম বারের মত ঢাকা সফরে আসেন। ২১শে মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এবং ২৪শে মার্চ বলেন একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ।

১৯৫২ সালের পুনঃ ভাষাআন্দোলন

খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫শে জানুয়ারী দেশে আসেন এবং পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তৃতা দেন। এ বক্তব্য মুলত মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ এর বক্তব্য়ের পুনরুক্তি ছিল। এরূপ বক্তব্যে বাংলার মানুষ যেন আরও চড়াও হয় এবং পুনঃ আন্দোলন শুরু হয়।

যুক্তফ্রন্টঃ প্রাদেশিক নির্বাচন কে কেন্দ্র করে ১৯৫৪ সালে  আওয়ামী লীগের নেতৃত্তে গড়ে রাজনৈতিক জোট হল যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের উদ্দেশই ছিল বাংলাদেশীদের অধিকার অত্তাছারের অবসান ঘটানো এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। যুক্তফ্রন্টের কর্মসূচি ২১ দফা কর্মসূচি ছিল। যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরপরই ভাষা আন্দোলন নতুন বেগ পায়।

১৯৭০ সালের নির্বাচন- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

বিক্ষিপ্ত আন্দোলন ধীরে ধীরে এর নতুন রুপ লাভ করে যা হল গণঅভ্যুত্থান। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল সরূপ পূর্ব পাকিস্তানিরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ঘোষণা পায়। এ সময় ১৯৭০এর ঘূর্ণিঝড়ের মধ্য দিয়ে সরকারে দায়িত্বহীনতা হারে হারে বুঝতে পারে জনসাধারন। যার প্রতিচ্ছবি যেন ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ এর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য বরাদ্ধকৃত ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে।

ক্ষমতা হস্তান্তরে নাটকীয়তা- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগের বিপুল ভোটে জয় লাভের পরও পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়না। এ সময় জুলফিকার আলী ভুট্টো ৬ দফা দাবী ভঙ্গ করে এবং নিজেকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান দাবী করেন।এ দাবিতে ১৬ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এক বিবৃতে বলেন যে দাবীর তীব্র নিন্দা জানায়। এ সময় ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করে কিন্তু ভুট্টো সাহেব তা প্রত্তাখান করেন। পরবর্তীতে ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ অনিশ্চিত কালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন।

৭ই মার্চের ভাষণ এ মুক্তি যুদ্ধের ডাক- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

ক্ষমতা হস্তান্তরে নাটকীয়তা দেখে সকল বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান খুদ্ধ হয়ে পরেন এবং ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সকলকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানায়। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সকলকে উদ্দেশ্য করে ঘোষণা দেন “এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।“এর মাধমেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন।

অপারেশন সার্চলাইট- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রসঙ্গে ১৬ই মার্চ ইয়াহিয়া খান ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বৈঠক হয়। এ বৈঠক এ যোগ দেওয়ার জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টো সাহেব ও ঢাকায় আসেন। এ বৈঠক ২৪ মার্চ পর্যন্ত সংগঠিত হয় কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে তারা পৌছতে পারেনি । এবং ২৪ শে মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো কোন বৈঠকের উদ্দেশ্যে নয় বরং এসেছিলেন এক নোংরা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি দেখতে।

আর বৈঠক ছিল এ প্রস্তুতি দেখবার বাহানা মাত্র। ইয়াহিয়া খান দেশ ত্যাগ এর পূর্বে নিরিহ বাঙ্গালির ওপর গুলি বর্ষণের নির্দেশ দেয়। নিরদেশনা অনুযায়ী ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে পাক হানাদার বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙ্গালির ওপর ঝাঁপিয়ে পরে। আক্রমন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে, পুলিশ হেড কোয়ার্টারস এ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। তুলে ধরে নিয়ে গুম করে দেয় দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডে নামই “অপারেশন সার্চলাইট”।

স্বাধীনতার ডাক- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

২৫শে মার্চ রাতের ভয়াবহতা দেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বুঝতে বাকি রইলনা কি হচ্ছে এবং সামনে কি হতে পারে। তাই তিনি পরিস্থিতি বুঝতে পেরে দেরি না করে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগেই একটি বার্তা বেতার সহযোগে প্রেরন করে দেন। এই বার্তায় তিনি বাংলাদেশকে “স্বাধীন” বলে অবহিত করে। যা তৎকালীন ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পরে। এ বার্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রথমবারের মত পূর্ব পাকিস্তানকে “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” বলে আখ্যায়িত করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলার ইতিহাস লেখে।এই যুদ্ধের মাধমেই বিশ্বের মানচিত্রে বাংলার লাল সবুজ পতাকা পৎ পৎ করে উড়ছে।

আশা করি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু হলে ও জানতে পেরেছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আরো বিস্তারিত যদি জানতে চান আমাদের সরাসরি কমেন্ট করতে পারেন। আপনাদের মতামতকে আমরা সবসময় সম্মানের চোখে দেখি।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

সমাপ্ত