You are currently viewing মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনী
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জীবনী

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী-বাংলার মজলুম জননেতা; পরাধীন পূর্ব বাংলা কে স্বাধীন বাংলাদেশ রূপে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসতে যেসকল নেতৃবর্গ আমৃত্যু অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি। যিনি রাজনীতিকে শুধু শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ভাসানি রাজনীতিকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন গ্রাম পর্যায়েও। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি তখন বলেছিলেন,”আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার। এই অঞ্চলগুলো ইন্ডিয়ার হাত থেকে ফিরিয়ে না আসা পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পাবে না।”তিনি চেয়েছিলেন পুরো বাংলাটা এক থাকক।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি তার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বাংলার সুবিধ বঞ্চিত, দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে গেছেন। তার কাছে মজলুমের কোনো জাত- ধর্ম- বর্ণ বলে কিছু ছিলো না। আর এজন্যই তিনি বাংলার ‘মজলুম জননেতা’ হিসেবেও সুপরিচিত। তিনি ছিলেন ব্রিটীশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ এবং গণ আন্দোলনের নায়ক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে গঠিত পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবদুল হামিদ খান ভাসানির গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। রাজনীতির ইতিহাসে তার অবদান বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অনুসরনীয় ও অনুকরণীয়।

আরো পড়ুনঃ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জীবনী

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা

মাওলানা আবদুল হামিদের (ডাক নাম ‘চেগা মিয়া’) জন্ম ১২ ডিসেম্বর, ১৮৮০ সালে সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামে। তার পিতা হাজী শরাফত আলী, মাতা মাঝিরান বিবি। আবদুল হামিদ সহ তারা চার ভাই ও এক বোন ছিলেন, তিনি ছিলেন সবার ছোট। ছেলে- মেয়েরা যখন খুব ছোট তখনই হাজী শরাফত আলী মারা যান এবং এর কিছুদিন পরই বেগম শরাফত আলী ও দুই ছেলে মারা যান। বেঁচে থাকেন শুধু আবদুল হামিদ ও তার বোন।

পিতৃহীন হয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রথমে চাচা ইব্রাহীমের কাছে আশ্রয় নেন। তখনকার সময় ইরাক থেকে সৈয়দ নাসির উদ্দীন বোগদাদী নামে একজন ধর্ম প্রচারক সিরাজগঞ্জে আসেন। আবদুল হামিদ ওই ধর্ম প্রচারকের আশ্রয়ে কিছুদিন থাকার পর ১৮৯৩ সালে চলে যান জমিদার শামসুদ্দীন আহম্মদ চৌধুরির বাড়ি; এটি অবস্থিত জহপুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলায়। সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাররেসের কাজের পাশাপাশি জমিদার বাড়ির ছেলে- মেয়েদের পড়ান।

১৮৯৭ সালে আবদুল হামিদ, ধর্ম প্রচারক সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে ভারতের আসাম রাজ্যে চলে যান। ১৯০৭ সাল পর্যন্ত তিনি ওস্তাযের কাছে তিনি আরবি, ফারসি,উর্দু, দর্শন ও তর্ক শাস্ত্র, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা সহ বিভিন্ন ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও জীবনমুখী শিক্ষা লাভ করেন।

এরপর ১৯০৭ সালে ইসলামি শিক্ষার জন্য আবদুল হামিদ দেওবন্দ চলে যান এবং সেখানে দুই বছর পড়াশোনা করে পুনরায় আসামে ফিরে আসেন। ওই সময় তিনি বিভিন্ন ইসলামি চিন্তাবীদদের সংস্পর্শে এলে তার মধ্যে সাম্রাজ্যবিরোধী চেতনা জেগে উঠে।

১৯১৭ সালে, যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে রাশিয়ার বিপ্লব সময়টা ছিলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ওই সময়ে আবদুল হামিদের পরিচয় হয় দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে, যার সহচর্য ও অনুপ্রেরণায় তার রাজনৈতিক মতাদর্শ ও চিন্তা-ভাবনা বিকশিত হয়। এরপর তিনি কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং ১০মাস কারাদন্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশএর গঠিত ‘স্বরাজ্য পার্টি’তে আবদুল হামিদ কঠোর পরিশ্রম করেন।

আরো পড়ুনঃ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জীবনী

মওলানা ভাসানীর বিয়ে

১৯২৫ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি প্রথম বিয়ে করেন আলেমা খাতুনকে। তিনি ছিলেন জয়পুরহাটের জমিদার শামসুদ্দীন আহম্মদ চৌধুরির কন্যা।

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী রাজনীতির পাশাপাশি ধর্মীয় ও পারিবারিক জীবনও সুন্দরভাবে পরিচালনা করেন। তার প্রথম স্ত্রী আলেমা খাতুনের পক্ষে ২টি মেয়ে ও ২টি ছেলে সন্তান এবং ২য় স্ত্রী হামিদা খানমের পক্ষে ২টি মেয়ে ও ১টী ছেলে সন্তান ছিলো।

তখন তিনি কৃষক ও ছিন্নমূল মানুষের কল্যাণের কথা বেশি ভাবতেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন- ইংরেজরা শাসনের নামে ভারতবর্ষের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শোষণ করছে। আর জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ না করলে এই শোষণ শেষ হবার নয়, আর কৃষকদের উন্নয়নও সম্ভব না।

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ক্যারিয়ার ও রাজনীতি

১৯২৬ সালে জমিদারি প্রথার বিরোধিতা করলে আবদুল হামিদকে ইংরেজরা ময়মনসিংহ সহ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে। তখন তিনি স্বস্ত্রীক আসামে চলে যান এবং সেখানেই প্রথম কৃষক- প্রজা আন্দোলন শুরু করেন। আসামের ‘ধুবড়ী জেলার’ ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে ১৯২৯ সালে কৃষক সম্মেলন করেন, আর এ জন্যই তাকে ‘ভাসানি’ উপাধি দেয়া হয়।

এরপর ১৯৩১, ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে যথাক্রমে সন্তোষের কাগমারীতে, সিরাজগঞ্জে ও গাইবান্ধায় বিশাল্ভাবে কৃষক সম্মেলন করেন। আবদুল হামিদ কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে আসেন ১৯৩৭ সালে।

শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও মাওলানা ভাসানি ১৯৪০ সালে লাহোরে ‘মুসলিম লীগের সম্মেলনে যোগ দেন এবং ১৯৪৪ সালে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।সেই সময়ে আসামের প্রচলিত ‘লাইন প্রথা’র বিরুদ্ধে মাওলানা ভাসানি যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন; তার জীবনী লেখক সৈয়দ আবুল মসুদের ভাষ্যে তা ‘ দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধীর বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তুলনীয়।”

আসাম জুড়ে বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে ১৯৪৫-৪৬ সালে ‘বাঙ্গাল খেদাও’ আন্দোলন শুরু হলে তিনি বারপেটা, গৌহাটি ও আসামের বিভিন্ন জায়গা পরিদর্শন করেন বাঙ্গালীদের রক্ষা করার জন্য।

আবদুল হামিদ খান ভাসানির জনপ্রিয়তা উপলব্ধি করে আসামের মূখ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোঃ সাদউল্লাহ বলেছিলেন,”ভাসানির মতো ৩জন নেতা হলে ইংরেজ স্ম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে দেয়া যেতো।”

এরপর ১৯৪৭ সালে ভারত- পাকিস্তান বিভক্তি আন্দোলনে মাওলানা ভাসানি গ্রেফতার হন এবং ১৯৪৮ সালে মুক্তি পেয়ে টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন। একই বছরে তিনি পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং স্পিকারের কাছে দাবি পেশ করেন ব্যবস্থাপক সভার কার্যাবলি বংলায় পরিচালনা করার জন্য।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯ মার্চের বাজেট বক্তৃতায় বলেন -”কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করা কর শতকরা ৭৫% প্রদেশকে দিতে হবে।”

কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে কর ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরা আদায় করার ফলে পূর্ব বঙ্গের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পরে। আর তখন মাত্র ৩৬ কোটি টাকা ছিলো পূর্ব্বঙ্গের বার্ষিক বাজেট। এসব নিয়ে সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন সদস্যরা নির্বাচনি ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে মামলা করায় আবদুল হামিদ ব্যবস্থাপক সভার পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

আরো পড়ুনঃ ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর জীবনী

পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মসলিম লীগ গঠিত

ভাসানির নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধি দল ‘পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মসলিম লীগ’ গঠিত হয় এবং তিনি সভাপতি হন। ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর খাদ্য সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করায় গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৫০ সালে ১০ ডিসেম্বর জেল থেকে বের হন।

পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার জন্য তনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারী ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ গঠণ করেন। এজন্য তাকে ১৬মাস কারানির্যাতন সহ্য করতে হয়।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হককে নিয়ে মাওলানা ভাসানি ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭টি থেকে ২২৮টি আসন পেয়ে বিপুল বিজয় অর্জন করে।

২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ পুনরুজ্জীবিত করেন এবং এর সভাপতি হন। ১৭ জুলাই ১৯৬৫, তিনি আইয়ুব খানের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং ১৯৬৬-এ শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ছয় দফা কর্মসূচি’র বিরোধিতা করেন।

১৯৬৯ সালের গনঅভ্যুত্থান, ৭০-এর প্রাদেশিক নির্বাচন, ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবকে সমর্থন ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

অবশেষে

অবহেলিত ও নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী আপোষহীন নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

মাওলানা ভাসানির লিখিত দুটি গ্রন্থ- ‘দেশের সমস্যা ও সমাধান’ এবং ‘মাও সে তুং-এর দেশে’।
৫২-র ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য ২০০২ সালে তিনি মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ পান এবং ২০০৪ সালে বিবিসি জরিপে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী’ তালিকায় ৮ম হন।

দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অন্তিম মূহুর্ত পর্যন্ত সমাজের মজলুম-অসহায়ের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কল্যাণের জন্য লড়াই করে গেছেন এই মহান নেতা। কোটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে গভীর ভালোবাসায় তিনি সিক্ত হয়ে আছেন ও থাকবেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।