Table of Contents
জিয়াউর রহমানের জীবনী ও রাজনীতি
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাব প্রাপ্ত হন। প্রথমে ছিলেন একজন সেনাপ্রধান এবং পরবর্তীতে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বিশিষ্ট এই রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি হিসেবে পরিচিত পরিচিতি লাভ করেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম ও জন্মসাল অথবা জন্মস্থান
বাংলাদেশের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ জিয়াউর রহমানের ডাকনাম হলো কমল। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৯ই জানুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট এই ব্যক্তির জন্মস্থান হলো বাংলাদেশের বগুড়া জেলার গাবতলির নাশিপুর ইউনিউনের বাগাবাড়ী গ্রামে।
জিয়াউর রহমানের বংশ পরিচয়
বাংলাদেশের অষ্টম প্রধানমন্ত্রী জিয়াউর রহমানের পিতার নাম হলো জনাব মনসুর রহমান এবং মাতার নাম জাহানারা খাতুন যার অন্যনাম রানী। জনাব মনসুর রহমান এবং জনাবা জাহানারা খাতুনের সন্তানদের মধ্যে জিয়াউর রহমান হলেন দ্বিতীয় তম সন্তান। জিয়াউর রহমানের দুইজন ছোট ভাইয়ের মধ্যে একজন হলেন আহমেদ কামাল যিনি ২০১৭ সালে মৃত্যু বরণ করেন আর অন্যজন খলিলুর রহমান যিনি ২০১৪ সালে মৃত্যু বরণ করেন।
জিয়াউর রহমানের বাবা জনাব মনসুর রহমান পেশায় ছিলেন একজন রসায়নবিদ বা সরকারি আমলা অর্থাৎ কলকাতার সরকারি দপ্তরের রসায়ন বিভাগের একজন কর্মচারী এবং যিনি কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং এ কাজ করতেন। যদিও পরবর্তীতে তিনি করাচিতে পাড়ি জমান। তখন জিয়াউর রহমান ছিলেন স্কুলের ছাত্র।
জীবনের প্রারম্ভিকতা বা ছোটবেলা
জিয়াউর রহমান প্রথম জীবনে বগুড়ায় তার গ্রাম বাগাবাড়ীতে বেড়ে উঠেন এবং স্থানীয় জিলা স্কুলেই পড়াশোনা করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান বিভক্ত হলে জিয়াউর রহমানের বাবা মনসুর করাচিতে পাড়ি জমান আর তখন জিয়াউর রহমান ও হেয়ার স্কুল ছেড়ে ১১ বছর বয়সে করাচি একাডেমির ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। চমৎকার কৈশরকাল তিনি করাচিতেই কাটান। ১৯৫২ সালে ১৬ বছর বয়সে করাচি একাডেমিক স্কুল থেকে মাধ্যমিকে কৃতিত্বের সাথে পাস করেন আর তারপর ডি. জে সিন্ধু সরকারি বিজ্ঞান কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। আর সে বছরেই অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে তিনি মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন অফিসার ক্যাডেট হিসেবে।
জিয়াউর রহমানের বিয়ে
১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান মধ্যপ্রাচ্যের মুরাদের উত্তরসূরি চা ব্যবসায়ী ইস্কান্দার মজুমদারের কন্যা খালেদা খানম পুতুলের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। খালেদা খানম পুতুলের বিবাহ পরবর্তী নাম হলো বেগম খালেদা জিয়া। বিয়ের সময়ে জিয়ার বাবা উপস্থিত থাকলে ও মা ছিলেননা। কারণ জিয়ার বিয়ের আগেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
বর্তমান ফেনি একসময়ে নোয়াখালী জেলার অংশ ছিলো আর পরবর্তীতে তা ভাগ হয়ে পড়ে। আর ফেনি’র মেয়ে হলো খালেদা খানম পুতুল। খালেদা খানম পুতুলের বাবা হলেন ইস্কান্দার আলী মজুমদার আর মা হলেন দিনাজপুরের মেয়ে তৈয়বা মজুমদার। খালেদা খানম পুতুল হলেন বাবা মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তৃতীয়, ২বোন তার বড় এবং ২ ভাই ছোট। ভাই দের একজন হলেন মেজর (অব) সাঈদ ইস্কান্দার এবং আরেকজন হলেন শামীম ইস্কান্দার যিনি অবসর প্রাপ্ত পাইলট ইঞ্জিনিয়ার।
একনজরে জিয়াউর রহমানের জীবন বৃত্তান্তঃ-
আসল নাম : জিয়াউর রহমান।
ডাকনাম : কমল
পিতার নাম : মনসুর রহমান।
মাতার নাম : জাহানারা খাতুন।
জন্ম তারিখ : ১৯জানুয়ারি।
জন্ম সাল : ১৯৩৬ সাল।
জন্মস্থান : বাগাবাড়ী, বগুড়া জেলা, বাংলাদেশ।
মৃত্যু : গুপ্তহত্যা, ৪৫ বছর বয়সে ৩০ মে ১৯৮১ সালে।
মৃত্যু স্থান : চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
কলেজ /বিশ্ববিদ্যালয় : ডিজে সিন্ধু বিজ্ঞান কলেজ, করাচির মিলিটারি একাডেমি, কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ।
জাতীয়তা : ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ।
ধর্ম : ইসলাম।
লিঙ্গ : পুরুষ।
বৈবাহিক অবস্থা : বিবাহিত
স্বামী / স্ত্রী : বেগম খালেদা জিয়া
বিয়ের সাল : ১৯৬০
সন্তানের সংখ্যা : ২জন।
সন্তানদের নাম : তারেক রহমান, আরাফাত রহমান।
পেশা : রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্মকর্তা, সাবেক রাষ্ট্রপতি।
পদমর্যাদা : লেফটেন্যান্ট জেনারেল।
ইউনিট : ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
কমান্ড : জেড ফোর্সের বিগ্রেড।
পুরষ্কার : বীর উত্তম, হিলালে – জুরাত, অর্ডার অফ দ্যা নাইল।
রাজনৈতিক দল : বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)
প্রতিষ্ঠার তারিখ : ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর।
পাকিস্তানের সামরিকবৃত্তি
জিয়াউর রহমান ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের করাচির মিলিটারী একাডেমীতে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দান করেন, আর দুই বছর পর ১৯৫৫ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে উন্নিত হয়ে প্যারাট্রুপার হন। আর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে একজন যোগ্য, দক্ষ কমান্ডো হিসেবে পরিচিতি ও লাভ করেন। সেখানে দুই বছর চাকরী করার পর ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ট্রান্সফার হয়ে চলে আসেন তারপর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ স্কুলে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সেনা কর্মী হিসেবে গোয়েন্দা বিভাগে নিযুক্ত ছিলেন। আর সে সময়েই অর্থাৎ ১৯৬০ পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুরের (নোয়াখালী তথা ফেনি’তেও বসবাস করতেন খালেদা জিয়ার পরিবার) কন্যা খালেদা খানম পুতুলের সাথে জিয়াউর রহমান বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
আইয়ুব খানের সফল এবং সামরিক বাহিনীর প্রতি বাঙালীর চিন্তভাবনার পরিবর্তনের ব্যাপারে জিয়াউর রহমান ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ি। তিনি ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার একটি যুদ্ধে ১০০- ১৫০ সৈন্যের একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে পাঞ্জাবের খেমকারান সেক্টরে নিজের বীরত্ব প্রকাশ করেন। আর সে যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার প্রকাশ এবং বীরত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পুরস্কার প্রাপ্ত হন। যে সব কোম্পানি যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলো জিয়াউর রহমানের কোম্পানি ছিলো সে সব এর মধ্যে অন্যতম একটি। জিয়াউর রহমান হিলাল-ই জুরাত খেতাব প্রাপ্ত হন। আর তাছাড়াও সে ইউনিট সিতারা-ই- জুরাত তথা সাহসের তারকা পদক এবং তামঘা-ই জুরাত তথা “সাহসের পদক” পদক প্রাপ্ত হন।
জিয়াউর রহমান ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান মিলিটারীতে পেশাদার ইন্সট্রাকটর পদে প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হলে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা স্টাফ কলেজে কমান্ড কৌশলি যুদ্ধের একটি কোর্সেও অংশগ্রহণ করেন, আর সে বছরেই তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাদের প্রথম সন্তান তারেক রহমানকে জন্মদেন । জিয়াউর রহমান মেজর পদে উন্নিত হওয়ার পর গাজিপুর জেলায় জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড কোর্সেও যোগ দিলে তারপর এডভান্সড মিলিটারি অ্যান্ড কমান্ড কোর্সে প্রশিক্ষণের জন্য জার্মানিতে পাড়ি দেন এবং ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর সাথেও কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হন। আর শেষে ১৯৭০ সালে মেজর হয়ে দেশে ফিরে চট্টগ্রামে অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে নিযুক্ত হন।
আরো পড়ুনঃ বেগম খালেদা জিয়ার জীবনী
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ অথবা মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইট নামক যে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করা হয় পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের উপর। সে রাতে বাংলার বন্ধু তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আর পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার পূর্বেই তিনি বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদরা মুক্তিযুদ্ধ কে সংগঠিত করার জন্য দেশবন্ধুর আদেশে আত্মগোপন করে এবং সেই রাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমনে জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করেন এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে তিনি প্রশংসা কুড়িয়ে নেন।
২৬ই মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীণতা ঘোষণা করে সেটি চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবের দেওয়া ঘোষণাপত্রের লিফলেট পাঠ করেন। আর সেটা পুরো দেশবাসি শুনে। আর এ ঘোষণাপত্র টি বিভিন্ন বেতারকেন্দ্র থেকেও প্রকাশ করা হয়। আর যেসব রাজনীতিবিদরা এ ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন তাদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন নবম।
কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হলে বেতার কেন্দ্রটি নিরাপত্তার অভাব বোধ করে আর তাই বেতার কেন্দ্রের প্রধান বেলাল মোহাম্মদ নিরাপত্তার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করলে ব্যর্থ হন আর পরবর্তীতে সেনা ছাউনিতে গিয়ে কথা বললে জিয়াউর রহমান রাজি হয়ে জিপ নিয়ে সেখানে স্থানান্তর হন।
বেতার কেন্দ্রের প্রধান বেলাল মোহাম্মদ জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সম্পর্কে যা বলেন তার মূল কথা হলো এই যে, মেজর হিসেবে জিয়াউর রহমান কে কিছু বলতে বলা হলে এবং পরবর্তীতে একটি কাগজ দেওয়া হয়, কাগজে উল্লেখিত শব্দাবলী তিনি পাঠ করেন এবং পরবর্তীতে বেলাল মোহাম্মদ ও তা পাঠ করে থাকেন। উল্লেখিত শব্দাবলী পাঠ করার পর খোদা হাফেজ জয় বাংলা বলেন। এরপর দুই থেকে তিন বার অ্যাডভান্স অ্যানাউন্সমেন্ট করার পর জিয়াউর রহমান নিজ কণ্ঠে ইংরেজি শব্দাবলী পাঠ করেন। যদিও তার ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে ধোঁয়াশা থেকে যায়। এ নিয়ে বিতর্ক ও রয়েছে।
জিয়াউর রহমান এবং তার বাহিনী সামনের দিক থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করে থাকেন। আর নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলদ্বয় কে নিজ আয়ত্বাদিন রাখেন। যদিও পরবর্তীতে কৌশলগতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর ১ নং সেক্টরে তিনি কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী এবং রাঙ্গামাটিসহ কতিপয় স্থানসমূহ সেক্টর এক কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করা হয়।
তিনি তিনটি ব্যাটালিয়ন সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম এবং নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড জেড ফোর্সের অধিনায়ক হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধে, যুদ্ধ পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবরূপে রূপান্তরের পিছনে এবং জেড ফোর্সে কমান্ডার হিসেবে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। যুদ্ধে বীরত্ব প্রকাশের ফল স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত হন।
জিয়াউর রহমানের সামরিক পেশার জীবন
জিয়াউর রহমান যে বিগ্রেডের সদস্যের উপর কর্তৃত্ব পরিচালনা করছিলেন, তাকে তাদের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেন সেনাবাহিনীর ৪৪তম বিগ্রেডের কমান্ডার করে স্বাধীনতার পর। জিয়াউর রহমান কে ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ পদে নিযুক্ত করা হয় ১৯৭২ সালের জুন মাসে। আর ১৯৭৩ এ বিগ্রেডিয়ার হলেও একই বছরে জেনারেল পদে পদোন্নতি করেন। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় হুসেইন মোহাম্মদ কে লেফটেন্যান্ট জেনারেল করেন এবং নিজেও একই পদবি গ্রহণ করেন।
মুজিব হত্যা
কথিত আছে যে, বৈদেশিক শক্তি এবং সামরিক বাহিনীর সদস্য দ্বারা অভ্যুত্থানে তার পরিবারের সদস্যসহ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে নিহত হন। মুজিব হত্যার পর মন্ত্রীসভার বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমাতার অপব্যবহারে সংবিধানে অধিষ্ঠিত হন। ১৫ আগস্টে শেখ মুজিব নিহত হলে ২৪ ই আগস্ট খন্দকার মোশতাক কর্তৃক জিয়া কে সেনা বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়।
মুজিবের মৃত্যুর ঠিক ১০ দিন পরেই জিয়া কে সেনা প্রধান নির্বাচন করার কারণে মুজিব হত্যার চক্রান্তে জিয়া সমালোচিত হয়ে থাকে। যদিও জিয়া ১৯৭৮ এর ডিসেম্বরেই সেনা বাহিনী হতে অবসর নেন।
মোশতাকের ক্ষমতার সময়ে মুজিবের খুনি ব্যক্তিরাই সামরিকের অফিসার পদে বহাল ছিলো। আর খুনি চক্র রাষ্ট্র পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে চাইলেই দেশে খারাপভাবে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। জিয়ার সেনা প্রধান হওয়ার পিছনের আলোচিত বিতর্ক গুলোর কারণে জিয়া অনেক বেশি সমালোচিত হয়ে থাকে। ৬নভেম্বর খন্দকার মোশতাক পদত্যাগ গ্রহণ করলে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম নতুন রাষ্ট্রপতি হন এবং জিয়াউর রহমান কে সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় আর সেনানিবাস এর বাস ভবনে যোগাযোগের বিচ্ছিন্নতা সনাক্ত করে গৃহবন্দি করা হয়।
আরো পড়ুনঃ আ স ম আবদুর রবের জীবনী
৭ ই নভেম্বরের অভ্যুত্থান
সেনাবাহিনীর একজন প্রখ্যাত অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমান সুপরিচিত ছিলেন। আর কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর ভিতরের জাসদ-সৃষ্ট গণবাহিনীর প্রধান। শ্রেণিবিহীন সেনাবাহিনী গঠন করার লক্ষ্য হলো গণবাহিনীর। যেটি চীনা পিপলস আর্মি কে বুঝানো হয়ে থাকে। জিয়াউর রহমান নিজ মুক্তির জন্য সহায়তা চাইলে তাহের সৈনিকদের একতাবদ্ধ করার জন্য ১২দফা দাবী উপস্থাপন করেন।
এই দাবি গুলো মূলত সিপাহীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই গঠন করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান কে মুক্ত এবং খালেদ মোশাররফ এর পতনের জন্যই এই ১২দফার উপস্থাপন এবং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্য সম্পাদন।
তাদের এই উদ্যোগে সেনা নিবাসে লিফলেট বিলি করা হয়। আর খালেদের নামের বিভিন্ন মন্তব্য প্রচার করা হয়। মন্তব্য গুলোর কয়েকটি হলো : সে ভারতের দালাল আর ভারতের জন্যই সে ক্ষমতায় এসেছে। এহেন পরিস্থিতে সামরিকের সাধারণ সৈন্যরা ৭ই নভেম্বরে পালটা অভ্যুত্থান ঘটায়। আর সৈনিকদের এ অভ্যুত্থানে অফিসারদের খুন করে এবং জিয়াউর রহমান কে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে তারা তাকে আর্টিলারির সদর দপ্তরে নিয়ে যায়।
আর সেদিনের পালটা অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে ক্ষুদ্ধ জওয়ানদের দ্বারা লেঃ কর্নেল খালেদ মোশাররফ সহ কতিপয় প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ নিহত হন।
আর জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দিয়ে কোলাকুলি করেন। জিয়াউর রহমান এ কথাও স্বীকার করেন যে জাসদ বা তাহেরের জন্য তিনি নিজেও জীবন দিতে রাজি। জিয়া গণবাহিনীর ১২দফায় সাক্ষর করলেও সৈনিকদের দাবি পূরণে অক্ষম বা উদাসিন হয়ে পড়লে কর্নেল তাহের ক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ে। সৈনিকগণ ক্ষুদ্ধ হয়ে অফিসারদের বাসভবনে ঢুকে মানুষ হত্যা করতে থাকে। সে বাসভবন থেকে বোরকা পরিহিতা মানুষদেরকে পলায়ন করতে দেখা যায়।
এবার কর্নেল তাহের জিয়াকে হত্যার ব্যাপারে মনঃস্থির করে। অনেক ক্যাপ্টেন এবং লেফটেন্যান্ট অফিসারগণ সৈন্যদের হাতে নিহত হতে থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে জিয়া সৈন্যদেরকে দমন করার চেষ্টা করে থাকেন। কর্নেল তাহেরকে বিভিন্ন অভিযোগে কারারুদ্ধ করা হয় আর বাকি জাসদ নেতাদের কে ও আটক করা হয়। আর ১৯৭৬ এ কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। তাহেরের মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময় পর এই মৃত্যুদণ্ড কে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমাতার মূল কেন্দ্রে চলে যান। ১৯৭৬ এ তাকে আবার সেনাবাহিনীর চিফ অফ আর্মি স্টাফ পদে নিযুক্ত করা হয়। আর জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে উল্লেখ করেন আর প্রতিবাদের কারণে উপ-সামরিক আইন প্রশাসক হন। আর বিচারপতি সায়েমের নামে জিয়া নিজেই ক্ষমতার অধিকারি ছিলেন।
সায়েম সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের কাজ করতে থাকে। আর এই নির্বাচনের জন্য তিনি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে দায়িত্ব দিয়ে ছিলেন। আর ঠিক সে সময়েই বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা সেনা নিবাসে উপস্থিত হতে শুরু করলে সায়েম তাদের ব্যাপারে অবগত থাকেন। সায়েমের আস্থাভাজন আব্দুস সাত্তার জিয়াউর রহমান কে ক্ষমতা দখলের জন্য ইন্ধন দিতে থাকে। জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এর সাথে রাষ্ট্রপতির পদ ও দখল করে।
জিয়াউর রহমান মহিলা পুলিশ গঠন করে কলোম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগ দেয় এবং সাত জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান পদে উন্নিত হন। রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় জিয়া গণতন্ত্রের উদ্যোগ নেয়। বহুদলীয় রাজনীতির জন্য মনঃস্থির করে।
১৯৭৮ সালে ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বীর বিপরীতে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠ হন। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়বাদের তত্ত্ব প্রদান করে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। স্থান, মত এবং ধর্মের ভিত্তিতে মানুষ নানা প্রকারের। তাই জিয়াউর রহমান মনে করেন ভূ-খণ্ডের ভিত্তিতে জাতীয়বাদকে গ্রহণ করা উচিত। সকল নাগরিকের ঐক্য সংহতির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন এবংভঐক্য প্রতিষ্ঠার শক্তি হিসেবে বাংলাদেশকে শক্তিশালী উপায়ে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান।
আরো পড়ুনঃ জাতীয় চার নেতার জীবনী
আইন শৃঙখলা
রাষ্টের ক্ষমতা অর্জনের পরই দেশের শান্তির পুনরুদ্ধারে লেগে পড়েন। পুলিশবাহিনী কে আগের চেয়ে দ্বিগুণ করে এর শক্তি নিশ্চিত করেন। সশস্ত্র বাহিনীর শক্তির ব্যাপারে নিশ্চিত হন এবং সকল বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যাপারেও সতর্ক থাকেন। জিয়াকে কয়েকটি সেনা বিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আর এহেন পরিস্থিতিতে তিনি আরো কঠোর হয়ে পড়েন।
বহুদলীয় গণতন্ত্র
নির্বাচন ব্যবস্থা বহাল থাকাকালে জিয়া রাজনৈতিক কার্যের সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক গণতান্ত্রায়ণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সংবাদপত্রের উপর থেকে বিধিনিষেধ দূর করার সাথে সাথে তথ্যের অবাধ প্রবাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৮ সালে আব্দুস সাত্তারকে উপ বিচারপতিতে অধিষ্ঠ করে জাতীয়বাদি গণতান্ত্রিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ছয়টি দলের মধ্যে তিনি ৭৬% ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকেন।
জাতীয়বাদি দল তথা বিএনপি
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান পহেলা সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ( বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। জিয়াউর রহমান এই দলের প্রথম চেয়ারম্যান এবং সমন্বয়ক হলেও বর্তমানে তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এই দলের চেয়ারপার্সন। জিয়ার তৈরিকৃত দলটিতে বামপক্ষ, ডানপক্ষ এবং মধ্যমপন্থিসহ সকল মানুষের স্থান রয়েছে।
১সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে রমনা রেস্তোরাঁয় বিকাল পাঁচটায় জিয়াউর রহমান সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন এই দলের আহবায়ক কমিটি হিসেবে ১৮ জন কে সিলেক্ট করা হয়। উল্লেখ যে, বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দ্বারা জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) এর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। যেটি বিএনপি গঠনের আগের কথা। জাগদলের সদস্যগণ নতুন দল বিএনপি কে সমর্থন করে এই দলে যোগদানের কথা জানান। জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থাতেই সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি ২৯৮ আসনের মধ্যে ২০৭ আসনে জয়লাভ করে থাকে।
আর্থ সামাজিক উন্নয়নে জিয়াউর রহমান
রাজনীতির সাফল্যগুলো আলোকপাত করা হলো। যথা:-
★ নির্বাচনে সর্বদলীয় উপস্থিতি বিদ্যমান।
★ সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করণের নিশ্চয়তা।
★ বিচার বিভাগ এবং সংবাদপত্র হতে সকল ধরণের নিষেধাজ্ঞা দূরিকরণ এবং স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া।
★ কৃষি, গণশিক্ষা এবং শিল্প উৎপাদনে বিল্পব।
★ স্বেচব্যবস্থা সম্প্রসারণে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন।
★ গণশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে অজ্ঞ মানুষকে শিক্ষাদান কর্মসূচির সঠিক ব্যবহার।
★ গ্রাম্যঞ্চলে সুখ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সোচ্চার হওয়া।
★ নতুন নতুম শিল্প কলকারখানা স্থাপন করে দেশের উন্নতি সাধন।
★ ২৭৫০০ পল্লি চিকিৎসক নিযুক্ত করে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।
★ ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রত্যেক ধর্মের মানুষ নিজ ধর্ম পালনে সচেষ্ট থাকা।
★ দক্ষিণ এশিয়ায় সার্ক গঠনের উদ্যোগ নেওয়া।
★ সকল অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি নিশ্চির করা।
★ শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রদান।।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিষয়বস্তু
জাতিয়তাবাদী দল গঠনের পর রাজনৈতিক দলের প্রশিক্ষণের জন্য মনঃস্থির করে কর্মী দেরকে জাতীয়তাবাদী দলের আদর্শ এবং নিয়মকানুন শিক্ষা দেওয়া হয়।
কর্মশালা উদ্বোধনের সময়ে তিনি বলেন রাজনৈতিক আদর্শ ধর্ম কেন্দ্রিক নয়। অবদান থাকলেও ধর্ম কে কেন্দ্র করে রাজনীতি সম্ভব নয়। যে সময়েই ধর্মকে কেন্দ্র করে দল গড়া হয়েছিলো তখনই তা বিফলে যায় আর তাই ধর্মের স্থান ধর্মের জায়গায়। রাজনীতি ধর্মকে কেন্দ্র করে হবেনা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি কূটনৈতিক নীতিমালায় যথেষ্ট পরিবর্তন আনেন। যুদ্ধের সময়ে আন্তর্জাতিক ভঙ্গির ভিত্তিতে কূটনৈতিক অবস্থানের সৃষ্টি হয়। যারজন্য প্রতিবেশি দেশ ভারতসহ সোভিয়েত ইউনিউনের অন্যান্য দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিরাজমান। জিয়াউর রহমান সোভিয়েত ইউনিউন ছাড়াও চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হোন। বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আরব আমিরাতের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা, স্বাধীনতার পর থেকে যাদের সাথে শৈত্য বিরাজ করে যাচ্ছে।
জাতীয় সংগীত এবং পতাকা পরিবর্তনের বিতর্ক
জিয়াউর রহমান জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন। ডা. ইউসুফ কোন এক অধিবেশনে জিয়া কে পতাকা পরবর্তনের অনুরোধ করলে তিনি যা বলেন তার মূলকথা হলো :- জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন হোক এরপর পতাকার কথা ভাবা যাবে। রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে বাংলা গান গাওয়া শুরু হলেও তা পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বন্ধ হয়ে যায়।
পতাকা পরিবর্তনের পক্ষপাতী জিয়া চেষ্টা করেছিলো পতাকার মধ্যে পরিবর্তন সাধিত করতে। সবুজ জমিনের উপর লাল বৃত্তের পরিবর্তে কমলার ব্যবহার করতে। প্রতিবাদের মুখে পড়ে শেষে জিয়াকে এরকম চিন্তাভাবনা থেকে দূরে অবস্থান করতে হয়।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যু
কথিত আছে যে, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধতাকারীদের তিনি দমন করার চেষ্টা করতেন। উচ্চপদস্থ লোকজন জিয়ার বিরুদ্ধে ছিলো। বিপদ জেনেও তিনি সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যকার কলহ থামাতে চট্টগ্রাম যান। আর সেই সার্কিট হাউসেই জিয়া নিহত হন। তাকে ঢাকার শে’রে বাংলা নগরে দাফন করা হয়। তার জানাজায় প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ সমবেত হয়।